রবিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় ১৩ প্রজাতি

মোস্তফা কাজল

বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় ১৩ প্রজাতি

দীর্ঘ হচ্ছে বিপন্ন বন্যপ্রাণীর তালিকা। ফলে হারিয়ে যাওয়ার পথে ১৩ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণী। এর মধ্যে ১০টি স্তন্যপায়ী, দুটি পাখি এবং একটি সরীসৃপ প্রজাতির। বাংলাদেশে প্রায় ১১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ীর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ       বিপন্নপ্রায়। এর মধ্যে রয়েছে হাতি, উল্লুক, লজ্জাবতী বানর, চশমা-পরা হনুমান, এশীয় কালো ভল্লুক, মায়া হরিণ, সাম্বার হরিণ, মেছোবিড়াল, ভোঁদড়, খাটাশ, কাঠবিড়ালি, বাদুড়, ডলফিন, শজারু, গয়াল প্রভৃতি। কয়েক দিন আগে রাজধানীর উপকণ্ঠের নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলা থেকে একটি মেছোবাঘ উদ্ধার করে জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। একসময় প্রায় দেশজুড়ে বাঘের বিচরণ থাকলেও এখন তা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে শুধু সুন্দরবনে। সুন্দরবনের অন্য দুই বাসিন্দা মেছোবিড়াল ও ভোঁদড়ের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল ও ক্ষুদ্র আয়তনের দেশ। ভৌগোলিক অবস্থান আর ঋতুবৈচিত্র্যের কারণে এ দেশে জীববৈচিত্র্য দেখা যায়। ফলে অনেক উন্নত দেশ থেকেও এ দেশ অনেক সম্পদশালী।

আইইউসিএন রেড ডাটা বুকের তথ্যমতে, বাংলাদেশের মোট বন্যপ্রাণীর প্রায় ১৫ ভাগ বিপন্ন। এ ছাড়া প্রায় ২৫ ভাগ সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। পরিবেশে নিজ নিজ ভূমিকা রাখার কারণে প্রাণীজগতের প্রতিটি  প্রাণীরই গুরুত্ব সমান। এ ছাড়া বিশালদেহী প্রাণীদের মধ্যে হাতি খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের কারণে বাংলাদেশের কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন স্থানে তারা বসতি গড়ে তুলেছে। এসব স্থানে বাংলাদেশের হাতি চলাচল করত। এ ছাড়া বিশ্বে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় উঠে এসেছে গয়াল বা মিথুন। কেউ কেউ আবার একে বনগরুও বলে। বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলের কয়েক জায়গায় কালেভদ্রে এদের দেখা যায়। গরুজাতীয় প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় গয়াল বাংলাদেশে মহাবিপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। জলজ পরিবেশ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় জলজ প্রাণীরাও হুমকিতে। সুন্দরবন এলাকার নদীগুলোতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। নদীদূষণ ও নাব্য কমে যাওয়ায় নদীতে আগের মতো দেশি মাছ দেখা যায় না। দেখা মেলে না ডলফিনের। গ্রামীণ পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া প্রাণী শিয়াল, বাগডাশা, বেজি, শজারুর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বন-জঙ্গল কমে যাওয়া ও আবাসস্থল সংকটের কারণে উল্লুক, চশমা-পরা হনুমান, লজ্জাবতী বানর, এশীয় কালো ভল্লুক, মায়া হরিণ, সাম্বার হরিণ হারিয়ে যেতে বসেছে। উল্লুুক ও চশমা-পরা হনুমান রয়েছে মহাবিপন্নের তালিকায়। বাংলাদেশের অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় সরীসৃপ নিয়ে গবেষণা কম হওয়ায় এ প্রজাতির তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। যে গবেষণা হয়েছে তা থেকে জানা যায়, দেশের প্রায় ১৫৮ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে ৬৩ প্রজাতি রয়েছে বিপন্ন ও মহাবিপন্নের তালিকায়। অজগর, লোনা পানির কুমির, ঘড়িয়াল, বোস্তামি কাছিম, পাতাকাছিম, অলিভ রিডলি কাছিম, গোখরা, শঙ্খিনী, সবুজ বোড়াসহ অন্যান্য বিষধর সাপ, গুঁইসাপ ও নানা প্রজাতির টিকটিকি এ-জাতীয় প্রাণীর মধ্যে অন্যতম। সুন্দরবন এলাকায় এখনো টিকে আছে অল্পসংখ্যক লোনা পানির কুমির। মিঠাপানির কুমির ইতিমধ্যে প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ঘড়িয়াল একসময় বাংলাদেশের সব বড় নদীতে পাওয়া গেলেও এখন বিলুপ্তপ্রায়। ছোট প্রাণীর মধ্যে উড়ুক্কু টিকটিকি, রক্তচোষার সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। নদীদূষণ ও ভরাট হয়ে যাওয়া, অবৈধ শিকারসহ নানা কারণে কাছিমের অবস্থা সংকটজনক। গ্রামগঞ্জের পুকুর বা অন্যান্য জলাশয়ে যে কাছিম আগে সহজেই দেখা যেত বর্তমানে তারা বিরল। পাহাড়ি অঞ্চলের কাছিমসহ সামুদ্রিক কাছিমের সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। সাপের বিভিন্ন প্রজাতিও রয়েছে প্রায় বিপন্নের তালিকায়। বিষধর বা বিষহীন দুই ধরনের সাপের সংখ্যাই দিন দিন কমে যাচ্ছে। জল ও স্থল উভয় পরিবেশে বসবাসকারী প্রাণীর নাম উভচর। বেঁচে থাকার জন্য এসব প্রাণীর দুই পরিবেশই অপরিহার্য। বাংলাদেশে প্রায় ৪৯ প্রজাতির উভচর প্রাণীর মধ্যে কয়েক প্রজাতির ব্যাঙ বিপন্ন। সুন্দরবনসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃত সবুজ ব্যাঙ বাংলাদেশের বিপন্ন উভচরের মধ্যে অন্যতম। উজ্জ্বল সবুজ রঙের বড় আকারের ব্যাঙের সংখ্যা আগে বেশি থাকলেও উপযুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ না পাওয়ায় দিন দিন এ প্রজাতির ব্যাঙ হারিয়ে যাচ্ছে। চিরসবুজ বনের বাসিন্দা লাল চীনা ব্যাঙও বিপন্নের তালিকায়। কীটনাশক ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থের কারণে মাটি ও পানিদূষণ, বাসস্থান ধ্বংসই এ প্রজাতির ব্যাঙের বিপন্ন হওয়ার প্রধান কারণ। সংশ্লিষ্টদের মতে, স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ ও উভচর ছাড়া প্রাণীজগতের আরেক সদস্য হলো পাখি। ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী প্রকৃতির এক অপূর্ব সৃষ্টি কয়েক প্রজাতির পাখির অবস্থাও আজ নাজুক। পাখির প্রধান আবাসস্থল বন-জঙ্গল ও জলাভূমি আজ মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। গোলাপিমাথা হাঁস ও ময়ূর বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে। বাংলা শকুন, মদনটাক, রাতচরা, পেঁচা, পাহাড়ি ময়না, পালাসি কুরা ঈগল, সাদাপেট সিন্ধু ঈগল, গাঙচষা, কালোমাথা কাস্তেচরা, সাপ, পাখিসহ অসংখ্য পাখি প্রজাতি আজ বিপন্ন। তবে পাখির মধ্যে বাংলা শকুনের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। গ্রামগঞ্জে মরা গরু খাওয়ার জন্য শকুনের ঝাঁকের আনাগোনা এখন অতীত। হাতে গোনা কিছু শকুন বর্তমানে বেঁচে আছে। বসবাসের উপযোগী গাছপালা, খাদ্যের অভাব ও গরুর চিকিৎসায় ব্যবহূত ডাইক্লোফেন নামক এক ধরনের ওষুধ শকুনের অস্তিত্বকে বিলুপ্তির দোরগোড়ায় নিয়ে গেছে।

সর্বশেষ খবর