সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

নির্বাচনে বিদেশি কাগজ কেনার আড়ালে অবৈধ বাণিজ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক

নির্বাচনে বিদেশি কাগজ কেনার আড়ালে অবৈধ বাণিজ্য

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুদ্রণকাজের জন্য বিদেশি কাগজ কেনার আড়ালে কোটি কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্যে লিপ্ত হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিসের একটি সংঘবদ্ধ চক্র। জানা গেছে, প্রভাবশালী এ চক্রের সদস্যরা বিপুল পরিমাণ অবৈধ আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে দেশীয় উন্নত মানের কাগজশিল্প ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্র করছে। স্টেশনারি অফিসের টেন্ডারে অংশ নেওয়া সর্বনিম্ন দরদাতাকে ডিঙিয়ে চতুর্থ দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদানের পাঁয়তারাও করছে। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবৈধভাবে নিম্নমানের বিদেশি কাগজ কিনে দেশকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে স্টেশনারি অফিসের রাঘববোয়ালরা। জানা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে ১০ সেপ্টেম্বর সাদা অফসেট কাগজ ক্রয়ে গুরুতর অনিয়ম ও সরকারি অর্থের অপচয়ের কথা উল্লেখ করে কার্যাদেশ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে যাওয়া একটি ভুক্তভোগী প্রতিষ্ঠান পত্র দিয়েছে। এই পত্রের অনুলিপি দেওয়া হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতরের মহাপরিচালককে।

ওই পত্রে বলা হয়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুদ্রণকাজের জন্য উন্নত মানের সাদা অফসেট কাগজ সংগ্রহ বা ক্রয়ের দরপত্র ৯ আগস্ট আহ্বান করে বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিস। এ দরপত্রে অংশগ্রহণকারী ছয়টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ঘোষিত হয় ওই ভুক্তভোগী প্রতিষ্ঠান। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বিপুল পরিমাণ অবৈধ আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে প্রথম সর্বনিম্ন দরদাতা ভুক্তভোগী প্রতিষ্ঠানকে ডিঙিয়ে চতুর্থ দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদানের পাঁয়তারা চলছে। উল্লেখ্য, ভুক্তভোগী প্রতিষ্ঠানটি প্রতি রিম ২ হাজার ২৩১ টাকা হিসেবে মোট ১১ কোটি ৮৭ লাখ ৪৯ হাজার ৪৩৭ টাকা এবং চতুর্থ দর প্রদানকারী প্রতি রিম ৩ হাজার ৬৬৩ টাকা দরে মোট ১৯ কোটি ৪৯ লাখ ৭০ হাজার ৫০১ টাকা দর প্রদান করেছিল। চতুর্থ দর প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানটি কার্যাদেশ পেলে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হবে ৭ কোটি ৬২ লাখ ২১ হাজার ৬৪ টাকা। পত্রে বলা হয়, ওই ভুক্তভোগী প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের কাগজ বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশে অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে রপ্তানি হচ্ছে। তাদের কাগজ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে দেশে-বিদেশে সমাদৃত। দেশীয় কাগজশিল্পের স্বার্থে ভুক্তভোগী প্রতিষ্ঠানটি স্টেশনারি অফিসকে বিশেষ অনুরোধ জানাচ্ছে। এই দরপত্রের সঙ্গে সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে কাগজের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন, যেমন কাগজের জিএসএম (গ্রাম পার স্কয়ার মিটার) ব্রাস্টিং ফ্যাক্টর, ব্রাইটনেস, স্মুথনেস, কেলিপার, ওপাসিটি ইত্যাদি বিষয়ে পরীক্ষা করিয়ে কাগজের গুণগত মান এবং তুলনামূলক দর বিবেচনায় নিয়ে ক্রয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

পত্রে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) অনুমোদন ছাড়া বিদেশি পণ্য আমদানি ও বাজারজাত করলে জেল-জরিমানাসহ অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। তাই অবৈধভাবে নিম্নমানের বিদেশি কাগজ ক্রয় করলে আইনের সরাসরি লঙ্ঘন হবে এবং একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী লাভবান হলেও দেশের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিসের উপপরিচালক সরোয়ার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিদেশি কাগজ কেনার ক্ষেত্রে আইনের লঙ্ঘন হলে আমার কিছু করার নেই। আসলে যে যেটা চায় সেটাই দিই। আমাদের কাছে চাহিদা প্রদানকারী যা চায়, আমরা তেমন কাগজ ক্রয় করি। আর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ।’

এর আগে ওই সংঘবদ্ধ চক্রটির সদস্যরা দেশীয় মানসম্পন্ন কাগজ উপেক্ষা করে আমদানি করা বিদেশি কাগজ গছিয়ে দিয়ে মোটা অঙ্কের কমিশন পাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। তারা বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিসের মাধ্যমে কাগজ সংগ্রহের জন্য ডাকা দরপত্রের (টেন্ডার) ভাষায় এমন শর্ত জুড়ে দিয়েছে, যাতে দেশীয় কাগজশিল্পের মিলগুলো অংশগ্রহণই করতে না পারে। এমনকি সরকারের ক্রয় নীতিমালার লঙ্ঘন করে শর্তের মধ্যে বিদেশি ব্র্যান্ডের নামও উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে। দরপত্রের শর্তে এ ধরনের সুনির্দিষ্ট ব্র্যান্ড ও বিদেশি কাগজের উল্লেখ করার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে দেশীয় কাগজ মিলগুলো। বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমএ) সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশীয় পণ্য উপেক্ষা করে বিদেশি পণ্য কেনার জন্য এ ধরনের শর্ত আরোপের পেছনে মূলত মোটা অঙ্কের কমিশনের বিষয়টি কাজ করছে। একশ্রেণির আমদানিকারক বিদেশি নিম্নমানের কাগজ গছিয়ে দিতে টেন্ডারে বিশেষ শর্ত আরোপ করিয়েছে, যা সরকারি নীতিমালার পরিপন্থী।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মুদ্রণকাজের জন্য ৫৩ হাজার ২২৭ রিম কাগজ ক্রয়ের লক্ষ্যে ২২ জুলাই দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিস। অফিসের উপপরিচালক সরোয়ার হোসেন স্বাক্ষরিত ওই দরপত্রে প্যাকেজ/পণ্য বর্ণনায় উন্নত মানের সাদা অফসেট কাগজ উল্লেখ করে ব্র্যাকেটে আবার ‘(বিদেশি)’ শব্দটি বসিয়ে দেওয়া হয়। ‘পেপার ওয়ান’ নামে একটি বিদেশি কাগজের নামও সেখানে উল্লেখ করে দেওয়া হয়। বিপিএমএ মনে করছে, এ ধরনের সুনির্দিষ্ট ব্র্যান্ড ও দেশের নাম উল্লেখ করে দরপত্র আহ্বান করা সরকারি ক্রয় নীতিমালার পরিপন্থী। এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বিপিএমএর সচিব এ কে এম নওশেরুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেখানে দেশীয় পণ্যের বিকাশে নানা ধরনের প্রণোদনা দিচ্ছেন, সেখানে দেশীয় শিল্পকে বাদ দিয়ে বিদেশি পণ্য কিনতে শর্ত দিয়ে দরপত্র আহ্বান করা সরকারি ক্রয়নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের পারচেজ পলিসি অনুযায়ী বিদেশি পণ্যকে উৎসাহিত করার সুযোগ নেই। সেখানে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান কীভাবে বিদেশি কাগজ উল্লেখ করে দিয়ে দরপত্র আহ্বান করে সেটি আমাদের বোধগম্য নয়।’

বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিসের উপপরিচালক সরোয়ার হোসেন ১ আগস্ট বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছিলেন, ‘পণ্য কেনার বিষয়ে আমাদের নিজস্ব কোনো পছন্দ নেই। সরকারের মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিভাগ (ডিপিপি) যে ধরনের পণ্য চায় আমরা সে ধরনের পণ্যের দরপত্র আহ্বান করি।’ নির্বাচনী কাজের জন্য নির্বাচন কমিশন বিদেশি কাগজ চেয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন কী চেয়েছে সেটি আমি বলতে পারব না। তবে ডিপিপি আমাদের কাছে বিদেশি কাগজ চেয়েছে।’

বাংলাদেশ পেপার মিল অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা জানান, দরপত্র আহ্বানকারী প্রতিষ্ঠান দরপত্রের শর্তে চাহিদাকৃত কাগজের বিবরণ, যেমন জিএসএম, ব্রাইটনেস, ওপাসিটির মতো কারিগরি বিষয় উল্লেখ করে দিতে পারে। এর ফলে মানসম্পন্ন কাগজ উৎপাদনকারী দেশি-বিদেশি উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষেও অধিকসংখ্যক অংশগ্রহণকারীর কাছ থেকে প্রতিযোগিতামূলক দরে কাঙ্ক্ষিত মানের পণ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। কিন্তু শর্ত দিয়ে বিদেশি পণ্য উল্লেখ করার বিষয়টি দেশীয় স্বার্থবিরোধী কাজ। ‘আমরা দেশীয় শিল্প যদি বিদেশি কোম্পানির চেয়ে ভালো মানের কাগজ প্রতিযোগিতামূলক দামে দিতে পারি, তাহলে কেন আপনি বিদেশি পণ্য কিনতে যাবেন’—বলেন দেশীয় কাগজ মিল-সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, অন্য দেশগুলো যেখানে দেশীয় পণ্যকে উৎসাহিত করতে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক বসিয়ে বিদেশি পণ্যকে বাধা দিচ্ছে, সেখানে উল্টো দেশে মানসম্পন্ন পণ্য থাকার পরও সরকারি প্রতিষ্ঠানে ডাকা দরপত্রে বিদেশি পণ্য কেনার শর্ত দেওয়ার বিষয়টি সন্দেহজনক। একশ্রেণির আমদানিকারক কমিশন দিয়ে এ ধরনের শর্ত আরোপের পেছনে সক্রিয় থাকতে পারে বলে মনে করছেন দেশীয় কাগজকল-সংশ্লিষ্টরা। বিপিএমএর তথ্য অনুযায়ী, কাগজশিল্প বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্প খাত। দেশে এখন ছোট-বড় মিলিয়ে ১০৬টি পেপার মিল রয়েছে। এসব কাগজমিলে বর্তমানে বিশ্বমানের সব ধরনের কাগজ উৎপাদিত হচ্ছে, যা প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বিদেশি কাগজের সমকক্ষ। বর্তমানে সরকারি দরপত্রের মাধ্যমে ক্রয় করা দেশীয় উন্নত মানের কাগজ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ব্যবহূত হচ্ছে। এ ছাড়া টাঁকশাল, দেশের সব শিক্ষা বোর্ড, বিভিন্ন সরকারি সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতেও দেশীয় কাগজ ব্যবহূত হচ্ছে। শুধু দেশে নয়, বিপিএমএর সদস্যভুক্ত মিলগুলোতে উৎপাদিত আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কাগজ বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ইউরোপসহ বিশ্বের ৩০টির বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ কাগজ ও কাগজজাতীয় পণ্য রপ্তানি করে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। কাগজজাতীয় পণ্য রপ্তানিতে প্রায় ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এ ছাড়া আমদানি-বিকল্প পণ্য উৎপাদন করে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করে এই শিল্প খাত জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

সর্বশেষ খবর