বুধবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

অসম বন্ধুত্ব

মির্জা মেহেদী তমাল

অসম বন্ধুত্ব

মহিউদ্দিন মিশু। রাজধানীর কাফরুলের ন্যাম গার্ডেনের বাসার সামনের রাস্তা থেকে নিখোঁজ হয় মিশু। কে বা কারা তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। রাজধানীতে একজন সরকারি কর্মকর্তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সন্তান নিখোঁজ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। পুলিশ প্রশাসনে শুরু হয় তোলপাড়। যে কোনো মূল্যে মিশুকে উদ্ধারের জন্য পুলিশের ওপর চাপ আসে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে। সময় গড়িয়ে যায়। মিশুর সন্ধান পায় না পুলিশ। জলজ্যান্ত সন্তান হঠাৎ হাওয়া হয়ে যাওয়ায় বাবা-মা পাগলপ্রায়। বাবা যুগ্ম সচিব পুলিশের বিভিন্ন বিভাগে ছোটাছুটি করছেন ছেলের সন্ধানে। ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পর খবর আসে মিশুর। অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির ফোন আসে সচিবের মোবাইলে। ‘হ্যালো, সচিব সাহেব! আপনার প্রাণপ্রিয় ছেলে মিশু আমাদের কব্জায়। ছেলেকে ছুটিয়ে নিতে ৬০ লাখ টাকা নিয়ে আসেন। এক হাতে টাকা দেবেন, আরেক হাতে ছেলেকে উঠিয়ে দেব। কোনো ধরনের চালাকি করবেন, ছেলে দূরের কথা, লাশও পাবেন না।’ এমন কথা শুনে কোনো জবাব দিতে পারেননি যুগ্মসচিব। ওপাশ থেকে ফোনের লাইন কেটে দেওয়া হয়। ওই নম্বরে বার বার চেষ্টা করেও আর খোলা পাওয়া যায়নি।

ফোনে মুক্তিপণের দাবি করায় হতাশ যুগ্ম সচিব। তিনি এত টাকা কোথায় পাবেন? কে দেবেন-এমন চিন্তা তার মাথায় এখন নতুন করে। মিশুর মা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। আর্তনাদ করছেন আর বলছেন, ‘আমি বুঝি না, জানি না, আমার ছেলেকে এনে দাও’। বাসা থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো বেরিয়ে যান মিশুর বাবা। পুলিশের সঙ্গে দেখা করেন। মুক্তিপণের বিষয়টি জানান। কিন্তু পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দারা কিছুই করতে পারছে না। মিশুর সিনিয়র বন্ধু হুমায়ুন কবির রয়েছেন যুগ্ম সচিবের সঙ্গে সঙ্গেই। যেখানেই যাচ্ছেন, সেখানেই আছেন তিনি। সহযোগিতা করছেন ভীষণ। মিশুর বাবা তার ওপর খুশি। বিপদের সময়ে হুমায়ুন কবিরকে তিনি পাশে পেয়েছেন। এমন দুর্দিনে কে কার সঙ্গে থাকেন!

মিশুর ঘনিষ্ঠদের মধ্যে হুমায়ুন কবির, যিনি কাফরুলের রোড মাস্টার গার্মেন্টের জেনারেল ম্যানেজার। তার বয়স চল্লিশ হলেও মিশুর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল তাদের। হুমায়ুন কবিরও বিভিন্ন স্থানে খোঁজখবর নিচ্ছেন। প্রতিদিন একসঙ্গে আড্ডা দিতেন হুমায়ুন কবির। যে কারণে প্রথম ঘটনা শুনে তিনিও আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন অনেকক্ষণ। দিন যায়, সপ্তাহ পেরোয়-সন্ধান নেই মিশুর। বাবা-মা আর কারও কাছে ধরনা দেন না। বাসার ভিতর বসে থাকেন। মাঝে-মধ্যে ফোনে যোগাযোগ করেন পুলিশ গোয়েন্দাদের সঙ্গে। এ কয়েক সপ্তাহে মিশুর বাবার বয়স যেন বেড়ে গেছে। চুল সাদা হয়ে গেছে। নির্ঘুম রাত কাটানোর স্পষ্ট ছাপ চেহারায় পড়েছে। সারা দিন শুয়ে বসে কাটান। অফিসেও যান না। ছুটি নিয়েছেন। সেদিন বাসায় শুয়ে আছেন। ছেলেকে নিয়েই চিন্তা তার। কয়েক দিন মুক্তিপণের জন্য ফোন এলেও এখন তা আর আসছে না। মিশুর সিনিয়র বন্ধু হুমায়ুন কবিরের গতিবিধি নিয়ে ভাবছেন মিশুর বাবা। তার কাছে কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে তাকে নিয়ে। কিন্তু তিনি কাউকে বিষয়টি বলছেন না। অপহরণকারীদের ফোন যখন আসত তখন হুমায়ুন কবিরকে কাছে পাওয়া যেত না। মুক্তিপণের টাকা দিয়ে দেওয়ার জন্যও হুমায়ুন কবির মাঝে-মধ্যে পরামর্শ দিতেন। এসব নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধছিল তার মনে। একদিন কাফরুল থানায় গিয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরও পর্যবেক্ষণের জন্য পরামর্শ দেন যুগ্ম সচিবকে। এভাবেই ছোটাছুটি করতে করতে কেটে যায় প্রায় দেড় মাস। হুমায়ুন কবিরের কিছু কর্মকাণ্ডে নুর উদ্দিন আহম্মেদ প্রায় নিশ্চিত, হুমায়ুন কবির এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তিনি কাফরুল থানায় একটি মামলা করেন। হুমায়ুনকে গ্রেফতার না করে নানা কৌশল নেয় পুলিশ। নানাভাবে হুমায়ুন কবিরকে চাপ দেয়। কৌশলে এড়িয়ে যান হুমায়ুন কবির। একপর্যায়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে জেরা করে। খুনের দায় কবুল করেন হুমায়ুন কবির। বলেন, মুক্তিপণের টাকার জন্য মিশুকে তার পরামর্শেই অপহরণ করা হয়। মিশু কোথায়? পুলিশের এমন প্রশ্নে, হুমায়ুন জানান, ‘ও আর নেই। তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তার দেওয়া তথ্যে পাবনার শাহজাদপুর এলাকায় গিয়ে অপহরণে জড়িত আরও চারজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বেরিয়ে আসে সব ঘটনা। শাহজাদপুরের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের হলুদ খেতের মাটি খুঁড়ে মিশুর গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। গোয়েন্দারা জানতে পারেন, হুমায়ুন কবির বন্ধুত্ব করেন মিশুর সঙ্গে। কৌশলে মিশুর পরিবারের সঙ্গে মিশে যান। হুমায়ুন কবিরের ধারণা ছিল যুগ্ম সচিবের অনেক টাকা আছে। যে কারণে মিশুকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করেন। কিন্তু তিনি মিশুর বাবার সঙ্গে থেকে বুঝতে পারেন, টাকা দিতে পারছেন না। যে কারণে ১৫ দিন পর তার সহযোগীদের তিনি জানান, মিশুকে মেরে ফেলতে হবে। কারণ ছেড়ে দিলে তাদের নাম ফাঁস হয়ে গেলে জেলে থাকতে হবে। যুগ্ম সচিব তাদের ছাড়বেন না।

বিচার : মহিউদ্দিন মিশু (২০) হত্যা মামলায় পাঁচজনের ফাঁসি ও তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছে আদালত। গত বছর ২৯ মে ঢাকার ১ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আতাউর রহমান এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন— হুমায়ুন কবির, আবুল কালাম, তরিকুল ইসলাম, ইসহাক ও কালাম ওরফে নম কালাম। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন— হাসেম দেও, রাজা ও বাদশা।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অসম বয়সের বন্ধুত্বেই কাল হলো মিশুর জন্য। তাকে জীবন দিতে হলো। অল্প কয়েক দিনের এই বন্ধুত্বেই সরল বিশ্বাসে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়েছিল হুমায়ুনকে। কিন্তু হুমায়ুন কবিরের মনের যে দুরভিসন্ধি তা বুঝতে পারেনি মিশু। এ ছাড়া এখানে মিশুর বাবা-মা অসম বন্ধুত্বের বিষয়টি খেয়াল করেননি। একটু সতর্কতাই হয়তো এমন ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখতে হতো না মিশুর বাবা-মাকে। অপরদিকে টাকার লোভে একটি জলজ্যান্ত মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে হুমায়ুন কবির। এতে করে তার মিশুর পরিবারের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, ক্ষতি হয়েছে তার নিজের জীবনের। তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হবে। অন্যথায় সারা জীবন কাটাতে হবে চার দেয়ালের মাঝেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর