শুক্রবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

অসঙ্গতি থাকলই যৌতুক নিরোধ আইনে

আইন কমিশনের মতামত উপেক্ষিত

আরাফাত মুন্না

অসঙ্গতি রেখেই জাতীয় সংসদ পাস করেছে যৌতুক নিরোধ বিল-২০১৮। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় উপস্থাপিত এ বিলটি পাস করার আগে এর নানা অস্পষ্টতা ও ত্রুটি তুলে ধরে সাত দফা সুপারিশ করেছিল আইন কমিশন। কিন্তু গত রবিবার সংসদে কণ্ঠভোটে পাস হওয়া ওই বিলে আইন কমিশনের মতামতগুলো উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। আইনজ্ঞরা বলছেন, আইন কমিশনের চিহ্নিত করা অসঙ্গতিগুলো দূর না করেই বিলটি পাস করায় বাস্তবে যৌতুক নিরোধ আইন একটি ত্রুটিপূর্ণ আইনে পরিণত হতে যাচ্ছে। কমিশনের মতামত গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন ছিল বলেও তাদের মত। এখন রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিলে বিলটি আইনে পরিণত হবে।

আইন কমিশন সূত্র জানায়, বিলটি পাস করার আগে তা যাচাই-বাছাই করার জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে দায়িত্ব দেয় জাতীয় সংসদ। স্থায়ী কমিটির গত ১৯ আগস্টের বৈঠকে আইন কমিশনের প্রতিনিধি কমিশনের পক্ষে সাত দফা সুপারিশ উপস্থাপন করেন। ওই বৈঠকের পর গত ৪ সেপ্টেম্বর বিলটির ওপর একটি প্রতিবেদনও পাঠিয়েছিল আইন কমিশন। নতুন আইনে ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ অধ্যাদেশ হালনাগাদ করে যৌতুক সংক্রান্ত মিথ্যা মামলায় কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। জানা গেছে, আইন কমিশনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, যৌতুক নিরোধ আইন একটি বিশেষ আইন হলেও বিলে এই আইনের প্রাধান্য দিয়ে কোনো বিধান রাখা হয়নি। ফলে ভবিষ্যতে আইনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এ ছাড়া সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে কে প্রতিকার প্রার্থনা করতে পারবে বা মামলা করতে পারবে তা সুস্পষ্ট করা উচিত বলে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়। কিন্তু পাস হওয়া বিলে এসব সুপারিশের বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। কমিশনের সুপারিশে যৌতুক দাবির অপরাধের বিচারের জন্য আদালত নির্ধারণের কথা বলা হলেও পাস হওয়া বিলে বিচারিক আদালত নির্ধারণ করা নেই। ‘মিথ্যা মামলাকারীর’ বিরুদ্ধে কে, কোন আদালতে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন, সেই অভিযোগ কোন আদালতে বিচার্য হবে, তা সুস্পষ্ট করার কথা বলেছিল আইন কমিশন। এ ছাড়া যৌতুক নিরোধ বিলে তামাদি বিধান যুক্ত করার সুপারিশও করা হয়েছিল কমিশনের পক্ষ থেকে। তবে পাস হওয়া বিলে এসবের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

আইন কমিশনের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা (জেলা জজ) ফউজুল আজিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের কাছে যে বিলটি পাঠানো হয়েছিল তা ছিল অস্পষ্ট ও অসম্পন্ন। আমরা এ বিষয়ে মতামতের জন্য আমাদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলাম। এরপর লিখিত সুপারিশও পাঠাই। তিনি বলেন, সুপারিশ পাঠানো আমাদের দায়িত্ব,             আমলে নেওয়া বা না নেওয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের। তাই এ বিষয়ে আমাদের আর কিছুই করার থাকে না। তবে মিথ্যা মামলা দায়েরের জন্য দণ্ড দিতে আইনে একটি ভালো বিধান রাখা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। জানতে চাইলে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইনটিতে কোনো সমস্যা ছিল না। এখন তো শুধু শাস্তি বৃদ্ধির জন্য নিয়ে আসা হয়েছে। তাই আগের আইনের প্রচলিত বিষয়গুলো বাদ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। অহেতুক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আগের আইন থেকে বাদ দিলে সেটার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। তিনি বলেন, শুনেছি নতুন আইনটিতে অনেক সমস্যা রয়েছে। বিলের কপি দেখার পরেই বিস্তারিত বলতে পারব।  আইন কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে তিনি বলেন, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দেশের একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি রয়েছেন। তিনি অবশ্যই অনেক অভিজ্ঞ। তাই কমিশনের মতামত অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। এ বিষয়ে জানতে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইন কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক করা হয়নি, এটা ঠিক। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা কর্তৃপক্ষের উচিত হবে কমিশনের মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা। তিনি বলেন, যৌতুক নিরোধ বিলের বিষয়ে আইন কমিশন যে অসঙ্গতিগুলো চিহ্নিত করেছিল, তা দূর না করায় এটি একটি ত্রুটিপূর্ণ আইনে পরিণত হতে যাচ্ছে। আর ত্রুটিপূর্ণ আইন কখনই সাধারণ মানুষের কাজে লাগে না।

সর্বশেষ খবর