সোমবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

আশপাশে জিম্মি বাহিনী

মির্জা মেহেদী তমাল

আশপাশে জিম্মি বাহিনী

সাভার রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা বা এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (ইপিজেড)। এই ইপিজেডকে কেন্দ্র করে আশপাশে বহু ধরনের কলকারখানা, হাট-বাজার, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ঘনবসতি আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়েছে। সেখানকার ভাড়া বাসা ফাঁকা পাওয়া কঠিন। বাসা খালি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ভাড়াটিয়া সেখানে উঠে যায়। যে কারণে এসব এলাকায় নতুন মুখ বেশি দেখা যায়। এমনি একটি এলাকা আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর। ছোট্ট এই এলাকায় বাজার দোকানপাট সবই আছে। বাজারের একটি ফার্মেসির মালিক আজমত আলী (ছদ্মনাম)। এলাকায় তিনি দীর্ঘদিন ধরেই আছেন। স্থানীয়রা তাকে চিনেন, ভালো জানেন। তার ফার্মেসির দোকানটি ভালো চলে।

আজমত আলীর সঙ্গে পরিচয় হয় এক যুবকের। প্রায়ই সন্ধ্যায় আজমত আলীর ফার্মেসির সামনের চেয়ারে এসে বসেন। চা পুরি খান। আজমত আলীকেও খাওয়ান। যুবকটি তাকে বলে, এলাকায় নতুন এসেছে সে। গার্মেন্টসে চাকরি করেন। তার কথাবার্তা আজমত আলীর ভালো লাগে। এক কথায় দু কথায় দারুণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে। এরপর প্রতিদিনই সন্ধ্যায় ফার্মেসিতেই আড্ডা। অনেক রাত পর্যন্ত যুবকটি ফার্মেসির সামনেই থাকে। আজমত আলীর ভালো-মন্দ খোঁজখবর নেয়। মাঝে মধ্যে ফল এটা সেটা বাসার জন্যে কিনে দেয় যুবকটি। আড্ডায় আড্ডায় একদিন সেই যুবকটি আজমত আলীকে বলে, তার কাছে বড় পার্টি আছে। তাদের প্রচুর ওষুধ লাগে। নগদ টাকার ব্যবসা। টাকা নিবেন, ওষুধ দিবেন। চাইলে সেই পার্টির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে সে। এমন লোভনীয় প্রস্তাবে আজমত আলী রাজি হয়ে যান। যুবকটি তাকে বলে, ঠিক আছে, কোনো সমস্যা নেই। সেই পার্টি সে ধরিয়ে দেবে। কয়েকদিন পর আজমত আলী তাকে বলে, কী ব্যাপার, আপনার সেই পার্টি কোথায়? ওর্ডার পেলে মাল উঠাব দোকানে। এ কথা শুনে যুবকটি বলে, পার্টি ঢাকার বাইরে ছিল। এখন এসেছে। তারা পরশু মাল নেবে। কাল তারা অ্যাডভান্স করে যাবে। এ কথা শুনে আজমত আলী ভীষণ খুশি। এমন পার্টি থাকলে ব্যবসায় অনেক লাভ, ভাবেন আজমত। পরদিন সন্ধ্যায় আজমত আলীর ফার্মেসিতে আসে সেই যুবক। এসে বলে, পার্টি তার গার্মেন্টসে এসেছিল। তাদের সময় কম বলে তাড়াহুড়ো করে চলে গেছে। তারা দুই লাখ টাকার ওষুধ নেবে। অ্যাডভান্স ২০ হাজার টাকা দিয়ে গেছে। এ কথা বলেই পকেট থেকে সেই টাকা আজমত আলীর হাতে তুলে দেয়। যাওয়ার সময় সে বলে যায়, ওষুধগুলো যেন লিস্ট অনুযায়ী রেডি করে রাখেন। আজমত আলী বলেন, আরে কোনো টেনশন নাই। সব রেডি থাকবে। পরদিন দুপুরের পর আজমত আলীর কাছে ফোন আসে। ওষুধ কেনার সেই পার্টির ফোন। তারা ২০ হাজার টাকা অ্যাডভান্স করেছে। পার্টি তাকে ফোনে জানায়, তারা আশুলিয়ায় আসতে পারছে না। ওষুধগুলো নিয়ে যেন তাদের দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। আজমত আলী তাদের পরে জানাবে বলে ফোন লাইন কাটে। তিনি ফোন দেন সেই যুবককে। যুবকটি তাকে জানায়, কোনো সমস্যা নেই। তারা যেখানে যাওয়ার কথা বলে, সেখানেই যেন ওষুধগুলো নিয়ে যায়। প্রয়োজনে সে নিজেও সেখানে থাকবে। এ কথা শুনে আজমত আলী দুই লাখ টাকার ওষুধ প্যাকেট করে রওনা হন। তিনি যাচ্ছেন টাঙ্গাইলের কাছে মধুপুরে। মধুপুরে পৌঁছতে তার সন্ধ্যা হয়। সেখানে যেয়ে পার্টিকে ফোন দেন। তারা মধুপুর এক জঙ্গলের ভিতরের দিকে যেতে বলে তাকে। তিনি সেভাবেই যেতে থাকেন। তবে ভয়ও পাচ্ছিলেন ভীষণ। কিছুদূর যেয়ে তিনি সেই যুবকের দেখা পান। বুকের ভিতর যে ভয় কাজ করছিল, যুবকটিকে দেখে সেই ভয় কেটে যায়। তিনি হাসি মুখে এগিয়ে যান যুবকটির সামনে। আজমতকে সেখান থেকে আরও ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি ছোট্ট ঘরে আরও বেশ কয়েকজনকে তিনি দেখতে পান। সে ঘরেই তাকে আটকে ফেলা হয়। আজমত আলী তাদের দেখার পর একটু সন্দেহ হয়। কিন্তু কিছু বলতে পারছিলেন না। তার পরিচিত যুবকটি হঠাৎ তাকে বলে ওঠে, আজমত সাহেব, বহু হয়েছে। আর না। ওষুধগুলো দিন। আর আপনার বাসায় ফোন করেন। পাঁচ লাখ টাকা পাঠাতে বলেন। ছয় মাস ধরে আপনাকে সময় দিয়েছি। টাকা না পেলে আপনার লাশ পড়ে থাকবে শালবনে। শিয়াল-কুকুরের সামনে লাশ ফেলে যাব আমরা। ভয় পান আজমত। তিনি বুঝতে পারেন, দীর্ঘ ছয় মাস ধরে বন্ধুর মতো করে যে যুবকটি তার ভালো-মন্দে ছিল, সে আসলে ভয়ঙ্কর অপহরণকারী চক্রের সদস্য। তিনি চক্রের ফাঁদে পা দিয়েছেন। এখন জীবন বাঁচানোই কঠিন হয়ে পড়েছে তার। সেখানে তার হাত-পা বেঁধে রেখে মারধর করা হয়। এরপর আজমত আলী তার পরিবারের কাছে ফোন দেয়। তিন দিন পর তাকে ছাড়িয়ে নিতে চার লাখ টাকা নিয়ে আসে স্বজনরা। টাকা নিয়ে আজমতকে জঙ্গলে ফেলেই চম্পট দেয়। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে মধুপুর জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে। ঘটনাটি গত মাসের।  আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো জানিয়েছে, এরা ভয়ঙ্কর জিম্মি বাহিনী। ভালো মানুষের মুখোশ পরে বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করে। তারা প্রথমে টার্গেট করে। পরে দীর্ঘ দিন ধরে সময় দিয়ে বন্ধুত্ব স্থাপন করে। আর সেই বন্ধুত্ব করেই টার্গেট করা ব্যক্তিকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করে। এমন অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে পুলিশের কাছে। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, অপরিচিত অজানা কোনো ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হওয়া কোনো ভাবেই কাম্য নয়। আগে জানতে হবে লোকটির সম্পর্কে। তবেই এ ধরনের কোনো ব্যবসায়িক ডিলে যাওয়া উচিত। নয়তো আজমত আলীর মতোই ভয়ঙ্কর ফাঁদে পড়তে হবে। যে কারণে সতর্ক আর সচেতন থাকাটা জরুরি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর