বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
ব্লু ইকোনমি

সাগরে সম্পদ আহরণের প্রস্তুতি

কেনা হয়েছে নিরাপত্তা জলযান, গবেষণা জাহাজ, জ্বালানির জন্য খনন হবে নতুন কূপ

জিন্নাতুন নূর

সাগরে সম্পদ আহরণের প্রস্তুতি

বঙ্গোপসাগর জুড়ে বিস্তৃত নীল জলরাশি। আর সাগরের সেই লোনাজল ঘিরে আছে বিপুল সামুদ্রিক সম্পদের হাতছানি। তবে এ জন্য প্রয়োজন সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তির পর বঙ্গোপসাগরে সম্পদ আহরণে এরই মধ্যে বাংলাদেশের বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে। এগুলো হলো— সমুদ্রের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় ক্রয় করা হয়েছে বেশ কয়েকটি জলযান; সামুদ্রিক মত্স্য ও প্রাণী আহরণ এবং গবেষণায় ক্রয় করা হয়েছে গবেষণা-জাহাজ ‘আরভি মীন সন্ধানী’; শিগগিরই সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নতুন কূপ খনন করার কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারত-শ্রীলঙ্কা-মালদ্বীপ এই চার দেশের সমন্বয়ে সীক্রুজ বা কোস্টাল ট্যুরিজমের ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনাও চলছে। এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় দেশের বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ক কোর্স চালু করা হয়েছে। আর সমুদ্রের সম্পদ রক্ষায় বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আধুনিক জাহাজ ও হেলিকপ্টার সংযোজনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সরকারের ব্লু ইকোনমি সেলের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে এসব জানা গেছে। অগ্রগতি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সরকারের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের     আওতায় সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে জরিপজাহাজ ভাড়া করার জন্য এক্সপ্রেশন অব ইনটারেস্ট (ইওআই) আহ্বান করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৩টি প্রস্তাবের মূল্যায়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে। এ ছাড়া সমুদ্রাঞ্চলে ননএক্সক্লুসিভ মাল্টি-ক্লায়েন্ট ২ডি সিসমিক সার্ভের বিষয়টিও বর্তমানে চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এটি সম্পন্ন হলে জরিপজাহাজ ভাড়া করার আর প্রয়োজন হবে না। এরই মধ্যে সাগরের ব্লক এসএস-০৪-এ একটি অনুসন্ধানকূপ খননের কার্যক্রম চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আর ব্লক এসএস-১১-তে স্যান্টোস কর্তৃক থ্রিডি সিসমিক সার্ভে সম্পন্ন হয়েছে। আশা করা হচ্ছে আগামী বছর মার্চের মধ্যে একটি অনুসন্ধানকূপ খনন করা হবে। আর গভীর সমুদ্রে ব্লক ডিএস-১২-তে ফসকো ডাইয়ু করপোরেশন কর্তৃক চলতি বছরের নভেম্বরে থ্রিডি সিসমিক সার্ভে করার কাজ পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সমুদ্রের সম্পদ রক্ষায় কোস্টগার্ডের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রথম ব্যাচের দুটি জাহাজ গত বছর প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক কমিশনিং করা হয়। দ্বিতীয় ব্যাচের দুটি জাহাজেরও কমিশনিং করার কথা রয়েছে। একই উদ্দেশ্যে শিগগিরই চারটি হেলিকপ্টারও কোস্টগার্ডে সংযুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। এ ছাড়া সমুদ্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও অবৈধ ট্রলার অনুপ্রবেশ রোধে বাণিজ্যিক ট্রলারগুলোকে স্থলভাগ থেকে মনিটর করার জন্য ১৩৩টি ট্রলারে ভেসেল মনিটরিং সিস্টেম সংযোজন করা হয়েছে। গভীর সমুদ্রে মত্স্য আহরণের লক্ষ্যে নয়টি লং লাইনার ও সাতটি পার্স সেইনার-জাতীয় মত্স্য নৌযানের অনুমতিপত্র প্রদান করা হয়েছে। আর গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মত্স্য আহরণের পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর বাইরে সমুদ্রসম্পদ রক্ষায় এবং উপকূলীয় এলাকা ও গভীর সমুদ্র এলাকায় নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ কোস্টগার্ড সমুদ্রগামী জলযান সংগ্রহ ও অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এরই মধ্যে চারটি অফশোর প্যাট্রোল ভেসেল দেশে এসেছে। আরও সাতটি ইনশোর প্যাট্রোল ভেসেল নির্মাণাধীন রয়েছে। আর আটটি আনম্যানড এরিয়াল ভেসেল ও চারটি হোভার ক্রাফট ক্রয়ের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীও সমুদ্র-সংলগ্ন নদী বা মোহনায় জরিপকাজের জন্য চারটি জাহাজ তৈরি করছে। এ ছাড়া চীনের নৌবাহিনী থেকে দুটি ফ্রিগেট ক্রয়ের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন আছে। ব্লু ইকোনমি সেলের প্রতিবেদনে বলা হয়, মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব গবেষণা জাহাজ ‘আরভি মীন সন্ধানী’র মাধ্যমে ২০১৬ সালের শেষ দিকে থেকে সমুদ্রে মত্স্যসম্পদের জরিপকাজ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে চারটি ক্রুজের মাধ্যমে ১৭৬ প্রজাতির মত্স্য, ১৩ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪টি অন্য প্রজাতির ক্রাস্টাসিয়ান ও মোলাস্ক চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০১৯ সালের জুনে এর জরিপকাজ শেষ করার পরিকল্পনা আছে। এ ছাড়া গবেষণা জাহাজ আরভি ডা ফ্রিটজফ ন্যানসেনের মাধ্যমে সমুদ্রাঞ্চলে মত্স্যসম্পদের ওপর অ্যাকুয়াস্টিক সার্ভে পরিচালনা শিগগিরই শুরু করা হবে। এ ছাড়া পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সমুদ্র ও নদীর মোহনায় জেগে ওঠা নতুন চর স্থায়ী করার লক্ষ্যে মোট ২২৮০ কিমি উপকূলীয় এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯৭৭ কিমি দীর্ঘ এলাকায় এরই মধ্যে বনায়ন শেষ হয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাংলাদেশ-ভারত-শ্রীলঙ্কা-মালদ্বীপ এই চার দেশের সমন্বয়ে সিক্রুজ বা কোস্টাল ট্যুরিজমের ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাংলাদেশ-মালদ্বীপের মধ্যে সি-ক্রুজ পরিচালনার জন্য প্রটোকল তৈরি প্রক্রিয়াধীন। আর বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মধ্যে কোস্টাল শিপিং অ্যাগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার তেল, গ্যাস, মূল্যবান খনিজ সম্পদ, মত্স্যসম্পদ আহরণ ইত্যাদির জন্য দক্ষ জনবল তৈরির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য স্বল্প ও মধ্য মেয়াদি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাপেক্সের জনবল দক্ষতা বৃদ্ধিতে ৪৫৫ জনকে বিদেশে এবং তিন হাজার ৫৯৬ জনকে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আর মেরিন ফিশারিজ একাডেমি থেকে প্রতিবছর নটিক্যাল, মেরিন, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং ও ফিশ প্রসেসিং বিষয়ে ৮০ জন দক্ষ জনবল তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় দেশের বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ক কোর্স চালু করা হয়েছে। এরই মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও কোর্স চালু করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ব্লু ইকোনমিকেন্দ্রিক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারের ২৫টি মন্ত্রণালয় এবং সংস্থার সমন্বয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ব্লু ইকোনমি সেল নামে স্বতন্ত্র সংস্থা গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া এ লক্ষ্যে সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সমন্বয় কমিটিও গঠন করা হয়।

সর্বশেষ খবর