বৃহস্পতিবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

লাইফওয়েতে লাইফ নেই

মির্জা মেহেদী তমাল

লাইফওয়েতে লাইফ নেই

ঝালকাঠির আবু হানিফের কাছে ফোন আসে বন্ধু মেহেদী হাসানের। হানিফকে জানায়, সে ঢাকায় একটি কোম্পানিতে চাকরি করছে। কোম্পানিতে একটি পদ খালি আছে। সুপারভাইজারের সেই পদে চাকরির সুযোগ আছে। হানিফ চাইলে ব্যবস্থা করতে পারে। মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতন। বন্ধুর এমন কথা শুনে চোখে পানি এসে গেল হানিফের। ভাবছিল, এ যুগে কে কার কথা মনে রাখে? তাও আবার চাকরির কথা জানিয়ে। হানিফ একটা ভালো চাকরির খোঁজ করছিল অনেকদিন ধরে। মেহেদীকেও জানিয়ে রেখেছিল। চাকরির কথা জেনে রাজি হয়ে যায় হানিফ। মেহেদী তাকে বলে, চাকরিতে যোগদান করলে থাকা, খাওয়া ও চিকিৎসা বাবদ কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী তাকে ৪৯ হাজার ৫০০ টাকা জমা রাখতে হবে অফিসে। এতেও রাজি হানিফ। তিন মাসেই টাকা উঠে যাবে। হানিফ তার বন্ধু মেহেদীর সঙ্গে কথা বলে চলতি বছরের ৫ মার্চ চাকরিতে যোগ দিতে টাকা নিয়ে ঢাকায় আসে। উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর রোডের ২৭ নম্বর বাড়ির পাঁচ তলায় লাইফওয়ে বাংলাদেশ প্রাইভেট লি. নামের কোম্পানিতে যায় হানিফ। বন্ধু মেহেদী ওই কোম্পানির মালিক নাহিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় হানিফকে। নাহিদ এ সময় হানিফের ভাইভা পরীক্ষা নেয়। কিছুক্ষণ পর তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়, পরীক্ষায় হানিফ পাস করেছে। এখন চাকরিতে তার যোগ দিতে বাধা নেই। তার আগে কিছু ফরমালিটিস রয়েছে। তা হলো সেই যে ৪৯ হাজার ৫০০ টাকার হাতবদল করতে হবে। টাকা দিয়ে রসিদ নিল হানিফ। তবে হানিফের কাছ থেকে অতিরিক্ত আরও সাড়ে ৩ হাজার টাকাও নেওয়া হয়।

অফিসের লোকজন হানিফকে বলে, ট্রেনিং শেষে তাকে কাজ বুঝিয়ে দেবে। উত্তরা আজমপুরে একটি ভাড়া বাসায় তাদের সাত-আট জনকে একত্রে রেখে সেখানে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। কোথাও বের হলে প্রতিষ্ঠানের একজন লোক তাদের সঙ্গে যেত। এমনকি মোবাইলে কথা বলার সময় তাদের একজন লোক পাশে থাকত এবং রাতে ঘুমানোর সময় বাইরে থেকে ঘরের দরজার তালা বন্ধ করে রাখা হতো। পরে অন্য একটি জায়গায় ফ্ল্যাটের ভিতরে তাদের ট্রেনিং করানো হয়। ট্রেনিংয়ে বিভিন্নভাবে লোক আনার কৌশল শেখানো হয়। লোক নিয়ে আসতে পারলে তাদের বেতন হবে বলে সাফ জানিয়ে দেয় অফিস কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানের মালিক নাহিদ, হায়দার কবির মিঠু, আবদুল কাদের, রুবেল ও জুনায়েদ তাদের ট্রেনিং করায়। কীভাবে কোম্পানিতে নতুন লোক নিয়ে আসতে হবে, তার বিভিন্ন কৌশল শেখায়। তাদের শেখানো কৌশল ও মানসিক চাপ প্রয়োগ করলে হানিফ তার এলাকার দুজন লোক নিয়ে আসে। তাদের কাছ থেকে একই কৌশলে টাকা আদায় করে আটকে রাখে এবং তা থেকে আবু হানিফকে বেতন হিসেবে ৪ হাজার টাকা দেওয়া হয়। তাকে আরও লোক নিয়ে আসার জন্য চাপ দেয় কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি সে কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে তার টাকা ফেরত চায়। প্রতিষ্ঠানটি তখন হানিফকে টাকা ফেরত না দিয়ে ছুটিতে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। হানিফ বুঝতে পারে সে প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়েছে। এভাবেই হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় লাইফওয়ে নামের প্রতিষ্ঠানটি। লাইফওয়ে যেন হয়ে ওঠে জীবন শেষের হাতিয়ার। একসময় পুলিশকে জানিয়ে দেওয়া হয়। ডিআইজি পিবিআই বনজ কুমার মজুমদার পিপিএমের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এমএলএম প্রতারণায় কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎকারী চক্রটির অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারেন। পিবিআই ঢাকা মেট্রোর একটি বিশেষ টিম গত ২ অক্টাৈবর উত্তরা পশ্চিম থানার ৭ নম্বর সেক্টরের একটি বাসায় অভিযান চালায়। সেখান থেকে গ্রেফতার হয় নাহিদ, নজরুল, রুবেল মিয়া, জুনায়েদ ও নাজমুল হোসাইন। পিবিআই জানতে পেরেছে, প্রতারণার শিকার ব্যক্তিদের আটকে রেখে কৌশলে তাদের মাধ্যমেই পরিচিত বন্ধুবান্ধব ও এলাকার স্বল্পশিক্ষিত লোকজনকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে অফিসে নিয়ে আসা হতো। পরে তাদের চাকরি হয়েছে জানিয়ে প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত ফরম পূরণ করিয়ে ছবি, নমিনির ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ফরমে সংযুক্ত করে স্বাক্ষর নেওয়া হতো। চাকরির জন্য থাকা, খাওয়া ও ট্রেনিং বাবদ তাদের কাছ থেকে টাকাপয়সা হাতিয়ে নেওয়া হতো। ট্রেনিংয়ে কীভাবে ওই কোম্পানিতে লোক নিয়ে আসতে হবে তার বিভিন্ন কৌশল শেখানো হয়। একজন লোক নিয়োগের পর তাকে আরও দুজন লোক নিয়ে আসতে বলা হয় এবং লোক নিয়ে আসতে পারলেই বেতন হবে বলে জানানো হয়। বেতন পাওয়ার আশায় তারা বন্ধুবান্ধবদের এই চক্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এভাবেই এক এক করে প্রত্যেকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে লাইফওয়ে। এরা সারা দেশেই সক্রিয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর