শুক্রবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভোটের মাঠে নেটওয়ার্ক জাল নোটের

সাখাওয়াত কাওসার

ভোটের মাঠে নেটওয়ার্ক জাল নোটের

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও দুর্গাপূজা সামনে রেখে সক্রিয় হয়ে উঠেছে জাল মুদ্রা প্রস্তুতকারী ও ব্যবসায়ীরা। অর্ধশত কোটি টাকার টার্গেটে জাল নোট প্রস্তুতকারীরা পার করছে ব্যস্ত সময়। নির্বাচন টার্গেট করে তারা রাজধানীর পাশাপাশি দেশের সব জেলা, থানা ও গ্রামে এরই মধ্যে প্রতিনিধি নিয়োগ করেছে। মাঠপর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে কীভাবে নকল টাকা ছাড়া হবে তারও নীল নকশা এঁকেছে তারা। সম্প্রতি গ্রেফতারদের কাছ থেকে পাওয়া এমন তথ্যে রীতিমতো উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্টরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে র‌্যাব-পুলিশ সক্ষম দাবি করলেও এই ভয়ঙ্কর অপরাধের তদন্ত, বিচার ও অপরাধীর জামিনের ক্ষেত্রে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বে জাল মুদ্রা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে জাতীয় কমিটি থাকলেও তাদের চরম গাফিলতির বিষয়টি স্পষ্ট। জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টিকারী এ বিষয়টিকে তারা খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের তৎপরতা একটা উদাহরণ হতে পারে। জাল রুপি ধরা পড়লে তারা তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নিচ্ছে। সম্প্রতি মাদকের বিষয়ে সরকার যেভাবে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে, জাল মুদ্রা কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আগে জাল মুদ্রার হোতাদের ধরতে হবে। তাদের মোটিভ কী এসব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বের করার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য তথা টাস্কফোর্সের সদস্যদের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে এ ধরনের অপরাধীদের ঢালাও জামিনের বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে কর্তৃপক্ষের। তবে নিয়মিতভাবে জাল মুদ্রা প্রতিরোধ-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সভা না হওয়াটা অত্যন্ত হতাশার।’ গত শুক্রবার বিকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রাজধানীর তুরাগ থানাধীন আট নম্বর ওয়ার্ডের বাউনিয়া বাদালদী রোডের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৫১ লাখ জাল টাকা ও এগুলো তৈরির সরঞ্জামসহ চক্রের প্রধান আবুল হোসেন ওরফে ইমন এবং তার সহযোগী শেখ সুমন, ছগির হোসেন ওরফে শাহীন, ইকবাল হোসেন, তৌকীর আহম্মেদ ওরফে সুজন ও নারী সদস্য স্বপ্নাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ সময় তাদের কাছ থেকে জাল নোট বিক্রির নগদ ২৯ হাজার টাকা, জাল নোট তৈরির প্রিন্টার, ফয়েল পেপার, ল্যাপটপসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের দুই দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। গ্রেফতার ছয়জনের মধ্যে সুমন ওরফে বিহারি সুমন এর আগেও একবার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল। কয়েক মাস জেলে থেকে জামিনে বের হয়ে ফের একই কাজ করছিল। এর আগে গ্রেফতার কাউসার, হুমায়ুন, শিপনসহ আরও অনেক শীর্ষ কারবারিও একাধিকবার গ্রেফতার হয়। ফের জামিনে থেকে তারা একই কাজ করছিল। তাদের মধ্যে সুমন ও স্বপ্না ছিল জাল নোট তৈরির কারিগর। আর জাল নোট সরবরাহ করত ছগির ও স্বপ্না। পল্টনের ব্যবসায়ী সুজন এই চক্রের কাছে জাল নোট তৈরির কাগজ ও কালি সরবরাহ করত। এর আগে ১৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর লালবাগ থেকে ৭৫ লাখ জাল টাকা ও এগুলো তৈরিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামসহ আটজনকে গ্রেফতার করে ডিবি। এর কিছুদিন আগে ৭ জুন কোটি টাকার জাল নোটসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করে ডিবি। এই ১০ জনের নয়জনই জাল টাকা তৈরির অভিযোগে এর আগে একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছে। সর্বশেষ গ্রেফতার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদকারী এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, আসছে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অন্তত ১০ কোটি জাল নোট ছাড়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এ জন্য তারা প্রতি সপ্তাহে ৪০ লাখ করে মাসে কমপক্ষে দুই কোটি জাল নোট তারা তৈরি করেছে। প্রস্তুত জাল নোট তারা বেসরকারি মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠান বিকাশের মাধ্যমে সারা দেশের এজেন্টদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। ঢাকা ছাড়াও খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, যশোর, বরিশাল, ফরিদপুর, বাঘেরহাট, সাতক্ষীরাসহ দেশের সব জেলা শহরে তারা প্রতিনিধি নিয়োগ করে রেখেছে। ওই প্রতিনিধিরা তাদের কাছ থেকে অগ্রিম নগদ (আসল টাকা) টাকায় জাল নোট কিনে রেখেছে। এরা সবাই মাঠপর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিনিধি হওয়ার চেষ্টা করছে। নির্বাচনের তিন মাসে শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন হবে, এর সুযোগ নেবে তারা। সারা দেশে আরও অন্তত ১০টি চক্র সক্রিয় রয়েছে। চক্রের দলনেতা আবুল হোসেন ইমন স্বীকার করেছেন, ধরা পড়ার আগে প্রায় চার বছর ধরে তুরাগের বি ব্লকের দুই নম্বর লেনের ১৬ নম্বর বাড়ির একটি ফ্ল্যাট ৩০ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়ে সেখানে জাল নোটের কারখানা তৈরি করেন। বাসার মালিক বিদেশে থাকেন। সহযোগীসহ তাকে ধরার সময় ওই ফ্ল্যাট থেকে সাত কোটি টাকার জাল নোট তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয় জানিয়ে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এই সরঞ্জাম ধরা না পড়লে জাল নোট তৈরি করে নির্বাচনের মাঠে ছড়ানো হতো। তবে ধরা পড়ার আগেই ১০ কোটি জাল নোট নির্বাচনী মাঠের জন্য ছেড়ে দিয়েছে তারা। ইমন স্বীকার করেন, নির্বাচনকে টার্গেট করে তিনি বাজারে কমপক্ষে ১০ কোটি জাল নোট ছেড়েছেন। ডিবির (উত্তর) উপকমিশনার মশিউর রহমান খান বলেন, জাল নোটের শীর্ষ পর্যায়ের বেশির ভাগ কারবারিকে বিভিন্ন সময় গ্রেফতার করা হয়েছিল। তবে তাদের অনেকেই জামিনে বের হয়ে একই কাজ করছে। এতে জাল নোট কারবারিদের নিয়ন্ত্রণ করতে তাদের অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। জানা গেছে, উৎপাদকের এক লাখ টাকার জাল নোট তৈরি করতে খরচ হয় প্রায় ১০ হাজার টাকা। পাইকারি বিক্রেতার কাছে তা বিক্রি হয় ১৪-১৫ হাজার টাকায়। এরপর খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে পাইকারি বিক্রেতা পায় ২০-২৫ হাজার টাকা। নজরদারি এড়াতে তারা বাজারজাতকরণের জন্য বেছে নেয় নারীদের।

সর্বশেষ খবর