রবিবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

পাঁচ পদক্ষেপে হবে যানজটমুক্ত ঢাকা

শিমুল মাহমুদ

অন্তত পাঁচটি পদক্ষেপ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে রাজধানীর দুর্বিষহ যানজট থেকে মুক্তি পেতে পারে নগরবাসী। এগুলো হচ্ছে— দ্রুত ও স্বল্প গতির যান চলাচলে পৃথক লেনের ব্যবস্থা, সড়ক ও ফুটপাথ দখলমুক্ত করা, ট্রাফিক আইনের কঠোর বাস্তবায়ন, গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইন্টারসেকশনে ওভারপাস নির্মাণ ও উন্নত বাস সার্ভিসের প্রবর্তন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ পাঁচটি পদক্ষেপ ও আরও কিছু কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে রাজপথের যানজট কমিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য পুলিশ, বিআরটিএসহ বিদ্যমান নগর উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। নিরবচ্ছিন্নভাবে কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে রাজধানীর পরিবহনব্যবস্থাকে। সূত্র জানায়, সম্প্রতি নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও সড়কপথে শৃঙ্খলা ফেরেনি। এর মূল কারণ হচ্ছে সমন্বয়হীনতা। এত বড় আন্দোলনের পরও রাজধানীর সড়কপথে সমন্বিত কোনো কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়নি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ প্রথমে ট্রাফিক সপ্তাহ ও পরে ট্রাফিক সচেতনতা মাস পালন করলেও এতে চালকদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। ফলে ট্রাফিক আইন অমান্যকারী চালকদের বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক মামলা দায়ের ও কোটি কোটি টাকা জরিমানা আদায় করা হলেও এ উদ্যোগে চূড়ান্ত সাফল্য আসেনি। এজন্য ডিএমপি কমিশনার হতাশা ব্যক্ত করেছেন। গত ৫ থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত দুই দিন বাড়িয়ে টানা ১০ দিন পালন করা হয় ট্রাফিক সপ্তাহ। এ ১০ দিনে ট্রাফিক আইন ভঙ্গসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে বিভিন্ন যানবাহন ও চালকের বিরুদ্ধে ৮৮ হাজার ২৯৩টি মামলা দেওয়া হয়। এ সময়ে জরিমানা করা হয় ৫ কোটি ১০ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। ট্রাফিক সার্জেন্টদের বক্তব্য হচ্ছে, শত চেষ্টা করেও নগরবাসীকে আইন মানতে সচেতন করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে ট্রাফিক সপ্তাহ শেষে নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, স্কাউট, বিএনসিসি, গার্লস গাইডসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সমন্বয়ে সেপ্টেম্বরকে ‘সচেতনতা মাস’ হিসেবে পালন করা হয়েছে। ৫ সেপ্টেম্বর সচেতনতা মাস শুরুর পর ২৫ দিনে যানবাহন ও চালকের বিরুদ্ধে প্রায় দেড় লাখ মামলা দিয়েছে ট্রাফিক পুলিশ। এ সময় জরিমানা আদায় করা হয়েছে ১০ কোটি টাকার বেশি। ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া সোমবার সোনারগাঁও হোটেল ক্রসিংয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা পরিদর্শন করতে গিয়ে বলেন, জনসাধারণের আইন না মানার প্রবণতায় সড়কের শৃঙ্খলা ফেরানোর সব চেষ্টা বিফলে যাচ্ছে। ট্রাফিকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও নগর বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পথচারী-চালকসহ সংশ্লিষ্ট নগরবাসী স্বেচ্ছায় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আইন মানতে সচেষ্ট না হলে কখনো সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়। একইসঙ্গে ফুটপাথ মুক্তকরণসহ পরিকল্পিতভাবে সড়কের অবকাঠামো উন্নয়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।

পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, কঠোর মনিটরিংয়ের পাশাপাশি সড়কের শৃঙ্খলা নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। শুধু পরিবহন চালকদের স্বেচ্ছাচারিতাকে যানজট ও বিশৃঙ্খলার একমাত্র নিয়ামক ভাবার কোনো কারণ নেই। সড়কে অবৈধ পার্কিং, নির্মাণসামগ্রী রেখে দেওয়া, ফুটপাথ দখলের কারণে নগরীর সড়ক ও ফুটপাথ পরিপূর্ণ ব্যবহার করা যায় না। অন্যদিকে বিভিন্ন গতির যানবাহন এক রাস্তায় চলার কারণে কোনো পরিবহনই গাড়িতে কাঙ্ক্ষিত গতি তুলতে পারে না। এজন্য বাস, কার ও ছোট থ্রি হুইলারের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। গাড়ির বৈধ ফিটনেস, রেজিস্ট্রেশন, ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কোনো যান ও ড্রাইভার যেন রাস্তায় না নামতে পারে। যেসব ইন্টারসেকশনে ট্রাফিকের চাপ বেশি সেখানে ওভারপাস নির্মাণ করতে হবে। সর্বোপরি রাস্তার পাশের বাজার, দোকানপাটসহ অননুমোদিত স্থাপনা কঠোরভাবে অপসারণ করতে হবে। পথচারী পারাপারের ফুটওভার ব্রিজ, জেব্রা ক্রসিংগুলোর যথাযথ ব্যবহার করতে হবে। পথচারীরা যাতে বিশৃঙ্খলভাবে দৌড়ে রাস্তা পার হতে না পারে সেই পারাপারের ব্যবস্থাটাই বন্ধ করে দিতে হবে। বিকল্প ব্যবস্থাগুলো সহজ করতে হবে। সর্বোপরি গণপরিবহনব্যবস্থা আরও আধুনিক করতে হবে। যাত্রীরা যাতে রাস্তায় নেমেই মানসম্পন্ন বাস পেয়ে যান সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত রাখতে হবে। নগরীর রাস্তাগুলো সিসি ক্যামেরার আওতায় আনতে হবে; যাতে ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের আইনের আওতায় আনা যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছেন, যানজটের কারণে প্রতিদিন বাংলাদেশে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। একই কারণে বছরে ক্ষতি হচ্ছে ৩৭ হাজার কোটি টাকার। অথচ উন্নয়ন সংস্থাগুলো সমন্বিত কার্যক্রম বাস্তবায়ন করলে নগরীর যানজট অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।

ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে মামলা ও জরিমানা শেষ কথা নয়। আমরা ট্রাফিক আইন মানার জন্য সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছি। পুলিশের নিজস্ব উদ্যোগে ঢাকা শহরে ১৩০টি বাস স্টপেজে ‘বাস স্টপেজ শুরু’ ও ‘বাস স্টপেজ শেষ’ লেখা সাইনবোর্ড বসানো হয়েছে। ঢাকা যানবাহন সমম্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বলেন, সবার মধ্যে আইন মানার মানসিকতা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো কঠিন। যানজট কমিয়ে আনা ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে যাত্রী, চালক উভয়েরই দায়িত্ব রয়েছে। তিনি বলেন, ট্রাফিক আইনের কঠোর মনিটরিং ও সড়ক ব্যবস্থাপনায় কিছু সংস্কার করা গেলে রাজধানীর যানজট অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।

সর্বশেষ খবর