সোমবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ছদ্মবেশী ভয়ঙ্কর অপরাধী

মির্জা মেহেদী তমাল

ছদ্মবেশী ভয়ঙ্কর অপরাধী

২৫ ডিসেম্বর, ২০১৩ সাল। বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোয় ব্রেকিং নিউজ। একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রবীণ ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমেদ (৭৫) খুন হয়েছেন। নিজ ফ্ল্যাটের বেডরুমে পাওয়া গেল তার লাশ। সাতসকালে এমন ব্রেকিং নিউজে তোলপাড় সারা দেশ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন সময়ে আলোচিত অসংখ্য দুর্লভ ছবি তুলেছিলেন আফতাব আহমেদ। তার তোলা ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, ৭ নভেম্বর সিপাহি বিপ্লব ইত্যাদি। তবে আফতাব আহমেদ সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিলেন ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় তোলা ‘জাল পরা বাসন্তী’র ছবির কারণে। বাসন্তীর সেই ছবি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সেই আলোচিত ফটো সাংবাদিকের নৃশংস খুনের খবর ছড়িয়ে পড়লে সরকারের ভিতরেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সংবাদ পেয়ে পুলিশ, র‌্যাব আর গোয়েন্দারা সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর পশ্চিম রামপুরার ওয়াপদা রোডের বাড়িতে পৌঁছে। তারা ফ্ল্যাটের লোহার ফটক ভেঙে আফতাব আহমেদের লাশ উদ্ধার করে। আফতাব আহমেদের মৃতদেহ পড়েছিল  মেঝের ওপর। তার মুখে ছিল স্কচটেপ। হাত-পা বাঁধা। দুষ্কৃতকারীরা তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করেছে বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়। দুষ্কৃতকারীরা আফতাব আহমেদের বেডরুম তছনছ করে। কে বা কারা কী কারণে আফতাব আহমেদকে হত্যা করেছে এ ব্যাপারে পরিবার ও পুলিশের পক্ষ থেকে কেউ নিশ্চিত হতে পারছে না। পুলিশের মাথায় কোনোভাবেই ঢুকছিল না যে, কেন এমন প্রবীণ লোককে হত্যা করা হবে। পুলিশের সন্দেহ হতে থাকে, তবে কী, তার কাছে থাকা দুর্লভ ছবি গায়েব করতেই দুর্বৃত্তরা এসেছিল? তবে ঘটনার পর থেকে আফতাব আহমেদের গাড়িচালক হুমায়ুন কবির ও রাজমিস্ত্রি লাপাত্তা। যে কারণে পুলিশের সন্দেহ হয় এ দুজনের ওপরও। গোয়েন্দারা তদন্ত শুরু করে। পশ্চিম রামপুরার ওয়াপদা রোডের ৬৩ নম্বরে চার তলা বাড়ির মালিক ছিলেন আফতাব আহমেদ। তিনি বাড়িটির তিন তলায় একা থাকতেন। বেশ কয়েকবছর আগে তার স্ত্রী মারা যান। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছেলে মনোয়ার আহমেদ সাগর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে যশোরে থাকেন। আর মেয়ে আফরোজ আহমেদ বর্ণা স্বামীসহ গাজীপুরে। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক পদে চাকরি করছেন। তার স্বামীও একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে তিন তলার ফ্ল্যাটটিতে একাই অবসর জীবন কাটাচ্ছিলেন আফতাব আহমেদ। দোতলায় একটি ফ্ল্যাট ছেলের জন্য বরাদ্দ। বাকি ফ্ল্যাটগুলোতে ভাড়াটিয়া রয়েছে। নাসিমা নামে একজন গৃহপরিচারিকা চার বছর ধরে আফতাব আহমেদের বাসায় রান্নার কাজ করতেন। হুমায়ুন কবির নামে তার একজন গাড়িচালক বাসার কেয়ারটেকার হিসেবেও কাজ করেন। গত এক তারিখে কবিরকে নিয়োগ দেন তিনি। এর আগে গৃহপরিচারিকা নাসিমার ছেলে নাজমুল তার গাড়ি চালাতেন। চুরির অভিযোগে নাজমুলকে চাকরিচ্যুত করেন তিনি। পরে নাজমুলই কবিরকে এনে দেন। গৃহপরিচারিকা নাসিমা জানান, প্রতিদিন সকাল ৯টার মধ্যে কবির বাসায় আসে। কিন্তু ঘটনার পর কবির বাসায় আসেনি। এমনকি তার মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়। কয়েক দিন ধরে একজন মিস্ত্রি বাড়ির কাজ করছিলেন। ঘটনার পর থেকে সেই মিস্ত্রিও বাসায় আসেনি। কদিন পর র‌্যাব রামপুরা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে সেই গাড়িচালক কবিরকে। গোয়েন্দারা এ সময় আফতাব আহমেদের সব খুনিকে গ্রেফতার করলেও সামনে আসে এক ভয়ঙ্কর অপরাধীর তৎপড়তার গল্প। যারা ছদ্মবেশে বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে চাকরি নেয়। সুযোগ মতো মালিকের বাসায় খুনসহ লুটপাট চালায়। ২০১০ সালে তারা সাভারেও একই কায়দায় হত্যা করেছিল গৃহকর্তাকে।

প্রবীণ আলোকচিত্র সাংবাদিক আফতাব আহমেদ হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতারকৃত সাতজন র‌্যাবের কাছে ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বর্ণনা দিয়েছে। সাত খুনি মিলে যেভাবে এই প্রবীণ সাংবাদিককে হত্যা করেছে তা শুনলে শিউরে উঠতে হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পর সাত খুনি লকার থেকে ৬৫ হাজার টাকা ভাগ করে নেয়। চালক হুমায়ুন কবীর ও হাবিব হাওলাদার র‌্যাবের কাছে স্বীকার করে যে, তাদের নেতৃত্বে ২০১০ সালে সাভার সিআরপি এলাকার একটি মেসে মুদি দোকানদার আলাউদ্দিনকে হত্যা করে লাশ সেপটিক ট্যাংকের ভিতরে রেখে দেওয়া হয়। এ ছাড়া তারা ডাকাতি ও ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে তারা জড়িত। তারা পেশাদার অপরাধী। চালক হুমায়ুন কবীর আফতাব আহমেদকে নিজ কক্ষে অনেক টাকা লেনদেন করতে দেখে। পেশাদার অপরাধী হুমায়ুন কবীর বিষয়টি তার অন্যান্য সহযোগীকে জানায়। তারা আফতাব আহমেদের বাসায় ডাকাতির প্রস্তুতি নেয়। দুই দিন আগে খিলগাঁও তালতলা এলাকায় এই পরিকল্পনা করে তারা। গাড়িচালক হুমায়ুন কবীর ও তার সহযোগী বেল্লাল হোসেন কিশলু, রাসেল, সবুজ, হাবিব হাওলাদার ও রাজু মিলে এই পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কিশলু, রাসেল, হাবিব, সবুজ, নিজাম ও রাজু পশ্চিম রামপুরা ওয়াপদা রোডে আফতাব আহমেদের বাসায় আসে। চালক হুমায়ুন কবীর সাংবাদিক আফতাব আহমেদকে জানায়, বাসা ভাড়া নিতে লোক এসেছে। তারা অ্যাডভান্স দেবে। আফতাব আহমেদ তখন খালি বাসাটি দেখানোর জন্য হুমায়ুনকে চাবি দেন। এ সময় বাকিরা তিন তলায় সরাসরি আফতাব আহমেদের কক্ষে ঢুকে বলে অ্যাডভান্স দিতে এসেছি। কিশলু একথা বলেই আফতাব আহমেদের জামার কলার ধরে কিল, ঘুষি মারে এবং টাকা-স্বর্ণালঙ্কার কোথায় আছে জানতে চায়। এতে আফতাব আহমেদ চিৎকার শুরু করেন। খুনিরা তখন টিভির সাউন্ড বাড়িয়ে দেয়। খুনিরা আফতাব আহমেদকে জাপটে ধরে মেঝেতে ফেলে দেয়। চালক হুমায়ুন কবীর গামছা গলায় লাগায়, সবুজ দুই পা চেপে ধরে। তারা আলমারি খুলে নগদ ৬৫ হাজার টাকা পায়। টাকা ও আফতাব আহমেদের মোবাইল ফোনটি নিয়ে তারা তিন তলার গেট ভিতর থেকে লক করে পালিয়ে যায়। ৬৫ হাজার টাকার মধ্যে চালক হুমায়ুন কবীর ১০ হাজার টাকা পেয়েছে বলে সে জানায়।

বিচার : একুশে পদকপ্রাপ্ত ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমেদ (৭৮) হত্যা মামলায় পাঁচ আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে আদালত। একজনকে দেওয়া হয়েছে সাত বছর কারাদণ্ড। গত বছর ২৮ মার্চ ঢাকার ৪ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবদুর রহমান সরদার এ রায় দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন, হুমায়ুন কবির মোল্লা, মো. বেল্লাল হোসেন কিশলু, হাবিব হাওলাদার, মো. রাজু মুন্সী ও মো. রাসেল। শেষের দুজন পলাতক রয়েছে। এ ছাড়া সাত বছর কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হলো মো. সবুজ মিয়া।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর