বুধবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

কৃষি থেকে শিল্পের ধারায় অর্থনীতি

১০০ ইকোনমিক জোনে কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ

মানিক মুনতাসির

কৃষি থেকে শিল্পের ধারায় অর্থনীতি

কৃষি থেকে শিল্পের ধারায় আবর্তিত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি, যার মাধ্যমে অধিক বিনিয়োগের পাশাপাশি কয়েক গুণ কর্মসংস্থান বাড়বে বলে মনে করে বেজা। সরকারের এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে দেশজুড়ে ১০০টি ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থাপিত সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে পারলে দেশের অর্থনীতির ধারাই পাল্টে যাবে বলে মনে করে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা)। এসব ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠায় সরকারের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ব্যক্তি খাতও। বসুন্ধরা গ্রুপ, আমান গ্রুপ, একে খান গ্রুপ, আবদুল মোনেম গ্রুপ ও মেঘনা গ্রুপসহ দেশের বৃহৎ ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো কাজ শুরু করেছে। এসব গ্রুপসহ বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানিকে ইতিমধ্যে ১১টি ইকোনমিক জোন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর কাজও এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে আগামী ১৫ বছরে কমপক্ষে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এসব জোনে স্থাপিত কল-কারখানা থেকে উৎপাদিত ৪০ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হবে, যা দেশের রপ্তানি খাতকে নিয়ে যাবে এক অনন্য উচ্চতায়। বেজা মনে করে, পাঁচ বছরের মধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর উৎপাদন শুরু হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়াবে কমপক্ষে ২ শতাংশ। এর ফলে দেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতির ধারা পাল্টে রূপ নেবে শিল্পনির্ভর অর্থনীতিতে। অবশ্য সেই পরিবর্তনের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে, যা কিছুদিনের মধ্যেই দৃশ্যমান হবে।

বেজা সূত্র জানায়, এসব জোনে কল-কারখানা স্থাপনে জমির কোনো অভাব থাকবে না। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ কোনো সার্ভিস সংযোগ নিয়ে থাকবে না অনিশ্চয়তা। শ্রমিক ধর্মঘট বা ভাঙচুরের আশঙ্কা থাকবে না। থাকবে সহজ যোগাযোগ আর পণ্য পরিবহনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। শতভাগ পুঁজি রক্ষা আর লাভের নিশ্চয়তা নিয়ে এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে পারবেন উদ্যোক্তারা। বেজা মনে করে, এসব জোনে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আর আগামী ১৫ বছরে কর্মসংস্থান হবে এক কোটি মানুষের। এরই মধ্যে ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর, সোনারগাঁও ও মুন্সীগঞ্জে নির্মাণাধীন ব্যক্তি খাতের ইকোনমিক জোনগুলোতে কর্মসংস্থান শুরু হয়েছে। এসব জোনে ভূমি উন্নয়নের পাশাপাশি অবকাঠামো ও কারখানা স্থাপনের কাজ চলছে দিনভর।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে এসব জোনের অনুমোদন দিয়েছেন। এসব জোনের ভূমি ও অবকাঠামোর উন্নয়নে পুরোদমে কাজ চলছে। এর মধ্যে সরকারি খাতের ৬৬টি জোনের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের আরও ১১টি ইকোনমিক জোনের কাজ চলছে সমান তালে। এর মধ্যে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপ দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লাইসেন্স পেয়েছে। সেখানে ফুড অ্যান্ড বেভারেজসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্প গড়ে তোলার কাজ চলছে। এতে কমপক্ষে ৪০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে বলে জানিয়েছে বেজা। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনামতেই এগিয়ে চলছে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করা। এসব কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা ও সরকারি পর্যায়ের ২০টির কাজ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। শিগগিরই এসব জোনে স্থাপিত শিল্পকারখানা উৎপাদনে যাবে। কয়েকটি ইতিমধ্যে স্বল্পাকারে উৎপাদনে গেছেও। সরকারি খাতের অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারাও নির্বিঘ্নে বিনিয়োগ করার সুযোগ পাবেন। এতে বিদেশি বিনিয়োগের খরা কেটে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। জানা গেছে, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ৩০ হাজার একর জমির ওপর নির্মিত হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনেতিক অঞ্চল। এখানে সব ধরনের কারখানা স্থাপনের সুযোগ থাকছে। মিরসরাই হবে একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্প সিটি। এতে শিল্পের কোনো কিছুরই অভাব থাকবে না। যে কোনো বিনিয়োগকারী বা ব্যবসায়ী এখানে যে কোনো খাতের কারখানা স্থাপন করতে পারবেন। তবে সেগুলো হবে অবশ্যই পরিকল্পিত। যেদিকে ওষুধ কোম্পানি থাকবে, সেদিকে আর অন্য কোনো খাতের কোম্পানি থাকবে না। অর্থাৎ খাতভিত্তিক কারখানা স্থাপিত হবে এই শিল্প সিটিতে। অবশ্য এ ধরনের নিয়ম থাকবে সব অর্থনৈতিক অঞ্চলেই। সূত্র জানায়, এখন থেকে অর্থনৈতিক এলাকা ও শিল্পাঞ্চল ব্যতীত অন্য কোনো জায়গায় শিল্প স্থাপনের অনুমোদন দেবে না সরকার। সব শিল্প খাতকে একই ছাদের নিচে আনতে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে খাতভিত্তিক শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলারও পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা সংবলিত অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পাঞ্চলে বিনিয়োগ করলে উদ্যোক্তাদের নানা ধরনের প্রণোদনা এবং ছাড় দেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছে মহাজোট সরকার। ইতিমধ্যে চীন, ভারত, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশের একাধিক ব্যবসায়ী গ্রুপ এসব জোনে বিনিয়োগের জন্য বেজার সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বিবিএসের তথ্যমতে, প্রতিবছর দেশের ২০ থেকে ২২ লাখ মানুষ কর্মবাজারে ঢুকছে। এদের একটা অংশ কাজের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমায়। আর বিরাট একটা অংশ দিনের পর দিন চাকরির পেছনে ঘুরে বেড়ায়। এদের সবাইকেই কর্মসংস্থানের আওতায় আনার কথা ভাবছে সরকার। ফলে এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে দেশের বেকার সমস্যার সমাধানও হবে খুব সহজেই, যা দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এসব অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় সরকার বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ডিএফআইডি এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থাও আর্থিক সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক চলতি বছরই প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে এই উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে। বেজা সূত্র জানায়, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় বিশ্বব্যাংক দশমিক ২৫ শতাংশে ঋণ দিচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাইকার দেওয়া ঋণের সুদহার আরও কম। এতে একদিকে যেমন সুদ কম দিতে হবে, অন্যদিকে ঋণ পরিশোধেরও সময়সীমা হবে দীর্ঘ, যা বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় কোনো ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে না বলে মনে করে সরকার। প্লাস্টিক, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং ফুটওয়্যার রপ্তানিপণ্য বহুমুখীকরণ, দক্ষ জনবল তৈরি ও কারিগরি কৌশল উন্নয়নের লক্ষ্যে মিরসরাই ইকোনমিক জোনে টেকনোলজি সেন্টার স্থাপনের কাজও এগিয়ে যাচ্ছে।

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের চরজুড়ে এখন বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। এরই মধ্যে এখানে ৮৩ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা। ১০০টি ইকোনমিক জোনের মধ্যে এটিই সর্ববৃহৎ জোন, যা প্রায় ৩০ হাজার একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত।

সর্বশেষ খবর