শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভিনদেশি অপরাধী

মির্জা মেহেদী তমাল

ভিনদেশি অপরাধী

অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভুয়া লটারি, বিদেশে উন্নত চাকরি ও মূল্যবান সামগ্রী দেওয়ার প্রলোভনসহ নানা কৌশলে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে সংঘবদ্ধ দেশি-বিদেশি প্রতারক চক্র। এ ধরনের প্রতারণার শিকারে পরিণত হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। প্রতারক চক্রের সদস্যরা পরিচয় হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, তারপর কথোপকথন, অতঃপর সখ্য গড়ে বিদেশ থেকে মূল্যবান উপহার পাঠানো, সবশেষে প্রতারণার ফাঁদ। বহুল ব্যবহূত এ কৌশলের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার পুরস্কার বা চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নামেও করা হচ্ছে প্রতারণা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের টার্গেট ফেসবুক ব্যবহারকারী নারী আর ব্যবসায়ী। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয় তাদের ব্যক্তিগত তথ্য। ফাঁদে ফেলে ধাপে ধাপে হাতিয়ে নেওয়া হয় কোটি টাকা পর্যন্ত। ঢাকায় সক্রিয় বিদেশিদের এমন প্রতারক চক্রের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। তাদের সহযোগী হিসেবে রয়েছে এ দেশের কিছু মানুষও। এসব চক্রের অনেক সদস্যকে বিভিন্ন সময় গ্রেফতার করা হলেও থেমে নেই সেই প্রতারণা। ঢাকার একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয় এক বিদেশি নারীর। নাম তার প্রিসকা খালিফা। ব্যবসায়ীকে ওই নারী জানান, তার বাবা ড. ডেভিড উইলসন খালিফার নামে লন্ডনের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন ইউএস ডলার জমা আছে। এ ডলারগুলো তোলার জন্য বিশ্বস্ত লোক ও কিছু টাকা প্রয়োজন। প্রিসকা খালিফার প্রলোভনের ফাঁদে পা দেন ওই ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী লিজা ও মহসিন নামে দুই বাংলাদেশির বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে কয়েক ধাপে জমা দেন ২৫ লাখ ৪৪ হাজার ১৪৪ টাকা। তারপর এই টাকা হাতিয়ে নেয় দেশি-বিদেশি প্রতারক চক্র। শুধু এই ব্যবসায়ীই নন, এভাবে অনেকেই দেশি-বিদেশি প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা দিয়েছেন। কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে দেশি-বিদেশি ওই প্রতারক চক্র। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা কাজে লাগিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিতে নতুন ফাঁদ পাতার খবর পেয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে নাইজেরীয় প্রতারক চক্রের সদস্য ও তাদের সহযোগী বাংলাদেশেরই নারী-পুরুষ এজেন্ট পরিচিত প্রতারক চক্রের সদস্য। তাদের যোগসাজশে শক্তিশালী এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এমনই এক প্রতারক চক্রের সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নাইজেরিয়ার চার নাগরিকসহ এই চক্রের সাতজনকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। তারা হলো লিজা আক্তার, তার কথিত স্বামী নাইজেরিয়ার জন আগডি ইউজিও, আফেজ, মাইকেল ইউজিনি ব্রাউন, নামডি কেলভিন, মো. মহসিন শেখ ও স্ত্রী তাসমিয়া পারভীন ওরফে শিমু। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে দেশি-বিদেশি প্রতারক চক্রের বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারের পাশাপাশি বিদেশিদের প্রতারণার অর্থ লেনদেনে জড়িত বাংলাদেশের বারোটি ব্যাংকও শনাক্ত করেছে পুলিশ। জব্দ করা হয়েছে গ্রেফতারকৃতদের ব্যবহূত মোবাইল ফোন, ল্যাপটপসহ বেশকিছু আলামত। ওই সাতজনের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলাও করা হয়েছে। বিদেশি প্রতারকরা তাদের এ দেশের এজেন্টদের (প্রতারক) মাধ্যমে বিভিন্ন ফন্দি এঁটে কৌশলে মানুষকে প্রতারিত করে আসছিল। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পেয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এ চক্রের সাত সদস্যকে গ্রেফতার করে ডিবির পুলিশ। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় দেশি-বিদেশি প্রতারক চক্রের সাত সদস্যকে। জিজ্ঞাসাবাদে বের হয়ে আসে প্রতারণার ফাঁদ পেতে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চাঞ্চল্যকর কাহিনী। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে গার্মেন্টসহ বিভিন্ন ব্যবসার আড়ালে তারা বাংলাদেশি ও বিদেশি নাগরিকদের যোগসাজশে এ ধরনের প্রতারণামূলক কাজ করে বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ করে আসছিল বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এ জন্য তারা ফেসবুক, ই-মেইল, হোয়াটস অ্যাপসসহ নানা ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। ভুক্তভোগী বাংলাদেশি দুই ব্যবসায়ীর অভিযোগ পেয়ে তদন্তে নামে ডিবি পুলিশ। গ্রেফতার হওয়া নাইজেরীয় প্রতারক চক্রের সদস্যরা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির সঙ্গে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রথমে বন্ধুত্ব তৈরি করে। এরপর তার সঙ্গে কিছুদিন কথা বলে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে।

পরবর্তীকালে ই-মেইল বা মেসেজের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকের ভুয়া কাগজপত্র পাঠিয়ে বিশ্বস্ততা তৈরি করে। প্রেমিকা কিংবা প্রেমিককে জানানো হয়, সে নাইজেরিয়া বা মালিতে কিংবা আফ্রিকায় থাকে। তার বা তার বাবার মিলিয়ন মিলিয়ন অর্থ আছে ব্যাংকে। তোমাদের দেশে টাকা বিনিয়োগের অনেক সুযোগ রয়েছে এবং এই বিনিয়োগ নিরাপদ। তাই আমি টাকা পাঠাব। তুমি সেটাকে কাজে লাগাবে। তোমার শ্রম আর আমার টাকা। পরবর্তীকালে সেই টাকা তুলতে গেলে বলা হয়, এর জন্য কিছু টাকা দিতে হবে। সরল বিশ্বাসে টাকা দিলে প্রতারণার শিকার হয় প্রতারকের সেই বন্ধু। কিন্তু সেই বাংলাদেশি বন্ধু, প্রেমিক বা প্রেমিকা যখন বুঝতে পারে যে তিনি প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন, তখন তার কিছুই করার থাকে না।

অনেক বাংলাদেশিকে এভাবেই ফাঁদে ফেলে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে দেশি-বিদেশি প্রতারক চক্রের সদস্যরা। প্রতারক প্রত্যেকের একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। কারও কারও ১০-১২টি অ্যাকাউন্টও রয়েছে। তাদের মধ্যে লিজার একটি অ্যাকাউন্ট থেকে কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে। এসব টাকা তারা দেশের বাইরে পাচার করতে বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করত। কখনো দামি পণ্য কিনে সেটা বিদেশে নিয়ে বিক্রি করে টাকা নেয়, কখনো হুন্ডির মাধ্যমে টাকা দেশের বাইরে পাচার করে। তাদের সঙ্গে বেশকিছু অসাধু মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীর যোগসাজশ রয়েছে। বিদেশিদের প্রতারণার অর্থ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশের এমন বারোটি ব্যাংক শনাক্ত করা হয়েছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনার সত্যতা খুঁজে পেয়েছে। ঢাকা মহানগর অঞ্চলের বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বিদেশি প্রতারক চক্রের কিছু সদস্যকে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার করেছে পিবিআই। সর্বশেষ ২ মার্চ তেজগাঁও থেকে নাইজেরিয়ানসহ দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রতারক চক্রগুলোর ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। ‘তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকায় নানা কৌশলে প্রতারণায় জড়িত বিদেশিদের সিংহভাগই নাইজেরিয়ার নাগরিক। খেলোয়াড় হিসেবে বা পড়ালেখার কারণ দেখিয়ে তারা কেনিয়া থেকে ভিসা নিয়ে এখানে আসে। পরে তারা জড়িয়ে পড়ে অপরাধে। সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া নাইজেরিয়ার নাগরিক হেনরি ইসিয়েকা ফুটবলার হিসেবে এ দেশে আসেন ২০১৫ সালে। একপর্যায়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এক্ষেত্রে ছদ্মনামে সুদর্শন এক যুবকের ছবি দিয়ে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলেন। বেছে বেছে নারীকে ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’ পাঠান। তারা বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করলে মেসেঞ্জার, ইমো বা হোয়াটসঅ্যাপে কথা চালিয়ে যান। বিশেষ করে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে এমন নারীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বলে পরিচয় দেন নিজেকে। বিশ্বাস অর্জনের জন্য যুক্তরাজ্যের ফোন নম্বর ব্যবহার করে খোলা ইমো বা হোয়াটসঅ্যাপ থেকে কল করেন। একপর্যায়ে টার্গেট নারীকে মূল্যবান উপহার পাঠানোর কথা জানান হেনরি। মূলত প্রতারণার শুরু তখন থেকেই। আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী পরিচয়ে চক্রের আরেকজন ওই নারীকে ফোন করে জানান, তার নামে বিদেশ থেকে মূল্যবান উপহার সামগ্রী এসেছে। বিমানবন্দর থেকে উপহারের পার্সেলটি ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য শুল্ক বাবদ প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা চাওয়া হয় তার কাছে। কাফরুলের এক স্কুলশিক্ষিকার সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটে গত বছর। তিনি ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা দেওয়ার পর বলা হয়, পার্সেলে প্রচুর পাউন্ড আছে। বিষয়টি একজন কাস্টমস কর্মকর্তা জানতে পারায় এখন পার্সেল ছাড়াতে আরও প্রায় দেড় লাখ টাকা লাগবে। ওই টাকা নেওয়ার পর ট্যাক্স বাবদ তিন লক্ষাধিক টাকা চাওয়া হয়। এ পর্যায়ে শিক্ষিকা কুরিয়ার কর্মীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে রাজি হন না তিনি। পার্সেলও আর পাননি সেই শিক্ষিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর