সোমবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর গ্যাস সিলিন্ডার

জিন্নাতুন নূর

ভয়ঙ্কর গ্যাস সিলিন্ডার

চাহিদা ভালো তাই লিকুডিফায়েড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবসার জন্য একের পর এক নতুন কোম্পানি আসছে বাজারে। কিন্তু এই ব্যবসায়ীরা নিজেদের লাভ বুঝলেও গ্রাহকের নিরাপত্তার বিষয়টি আমলে নেন না। চলতি বছরের এপ্রিলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, দেশে এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার বাজারজাত ও সরবরাহের প্রাথমিক অনুমতি পেয়েছে ৫৫টি কোম্পানি। কিন্তু মাত্র পাঁচটি কোম্পানি চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে। আর ১১টি কোম্পানি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের অনুমতি ছাড়াই ব্যবসা করছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, হাতে গোনা দু-একটি স্বনামধন্য ব্র্যান্ডের এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার কোম্পানির সেবায় গ্রাহক সন্তুষ্ট থাকলেও বাজার ধরতে বাজারে ঢুকে পড়ছে অখ্যাত বেশ কিছু কোম্পানি, যারা কোনো ধরনের মান রক্ষা না করেই নিম্নমানের গ্যাস সিলিন্ডার বাজারজাত করছে। এতে একদিকে গ্রাহক যেমন ঠকছেন, তেমনি বাড়ছে ভোগান্তি। আশঙ্কার বিষয়, সম্প্রতি আবাসিকে ব্যবহৃত এমন কয়েকটি নিম্নমানের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নিহত ও গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বনামধন্য দু-একটি কোম্পানি মান বজায় রেখে গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহ করছে। বাকিরা মান রক্ষার ব্যাপারে উদাসীন। তাদের মতে, এই গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের সঙ্গে যেহেতু মানুষের জীবন-মৃত্যুর বিষয়টি জড়িত, এজন্য নিরাপত্তার খাতিরে এবং দুর্ঘটনা রোধে গ্রাহকদের অবশ্যই মানসম্মত সিলিন্ডার ব্যবহার করা উচিত। তারা জানান, সিলিন্ডারে সাধারণত গ্যাসভাল্ব, হোসপাইপ, রেগুলেটর ইত্যাদি লিক হয়ে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এ জন্য সিলিন্ডারের রেগুলেটর বন্ধ করে সেইফটি ক্যাপ লাগাতে হবে। নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখতে হবে সিলিন্ডার লিক হচ্ছে কি না। এ ছাড়া এলপিজি সিলিন্ডার কেনার সময় ক্রেতাদের উৎপাদনের তারিখ দেখে নেওয়া উচিত।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের তথ্যে, ২০১৬-১৭ এই এক বছরে মোট চুলা থেকে সৃষ্ট কারণে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে ২৩৮টি। আর এ সময় গ্যাস লিকেজের ঘটনা ঘটেছে পাঁচ হাজার ৬৫০টি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা নামকাওয়াস্তে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে যথাযথ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন না নিয়েই যেখানে-সেখানে এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবসায় নামছেন। আর খুচরা ব্যবসায়ীরা বিস্ফোরক অধিদফতরের সনদ ছাড়াই গ্যাস সিলিন্ডার মজুদ করছেন। অবৈধভাবে সিলিন্ডার গ্যাস, নিম্নমানের রেগুলেটর, নিম্নমানের গ্যাস সরবরাহ পাইপের জন্য অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের মতো দুর্ঘটনা ঘটছে। রাজধানীর নতুন বাসাবাড়িতে গ্যাসের সংযোগ না দেওয়ায় রান্নার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে লিকুডিফায়েড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজি। আবার নগরীর হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও ছোট চায়ের দোকানেও বোতলজাত এই গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে। এই সুযোগে বিগত কয়েক বছরে এলপিজি গ্যাসের বাজারে ঢুকে পড়েছে অখ্যাত ও নিম্নমানের বহু কোম্পানি। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার পাড়া-মহল্লায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে গ্যাস সিলিন্ডারের দোকান, যেখানে বিভিন্ন নিম্নমানের কোম্পানির সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে। আবার মুনাফালোভী কিছু ব্যবসায়ী ও কোম্পানি নিজেদের লাভের বিষয়টি নিয়ে যতটা সজাগ, গ্রাহকদের নিরাপত্তা নিয়ে ততটা নন। মান বজায় না রেখে তারা ঘরবাড়ি ও রেস্টুরেন্টে সরবরাহ করছেন নিম্নমানের গ্যাস সিলিন্ডারের বোতল। আর এসব বোতলের কারণে সৃষ্ট দুর্ঘটনায় বাড়ছে হতাহতের আশঙ্কা। সরকারের বিস্ফোরক অধিদফতরের এই সিলিন্ডার বোতলগুলো পরীক্ষা করার কথা। এমনকি গ্যাস সিলিন্ডার থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনার কারিগরি তদন্ত করার কথা সংস্থাটির। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার প্রতি পাঁচ বছর পর সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা করার কথা। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরেই পুরনো সিলিন্ডারগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই। যদিও এর মধ্যে কিছু সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা করার দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি। কিন্তু বিস্ফোরক অধিদফতরের জনবল স্বল্পতায় এ কাজ করা বেশ কঠিন। বিস্ফোরক অধিদফতরের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে মোট আমদানিকৃত এলপিজি সিলিন্ডারের সংখ্যা ৩৯ লাখ ৬৪ হাজার ৭২৮। আর অনুমতিপ্রাপ্ত দেশে তৈরি এলপিজি সিলিন্ডার বাজারজাতকরণের সংখ্যা ১১ লাখ চার হাজার ৩৪৫। দেশে মোট সিলিন্ডার পরীক্ষার কেন্দ্র আছে ছয়টি। আর এলপিজি সিলিন্ডার নির্মাণ কারখানা আছে চারটি। এই প্রতিবেদনে একটি দুর্ঘটনা কেস-স্টাডি থেকে জানা যায়, বেশ কিছুদিন আগে খুলনা মহানগরীর সদর থানাধীন ৪৮/৩ আহসান আহমেদ রোডে ‘নিউ রোস্টার কিং’ নামক ফাস্টফুডের দোকানে রেগুলেটর অন থাকায় সিলিন্ডারের ভাল্বের রাবারের কোনো অংশ দিয়ে অথবা রেগুলেটরের সংযোগস্থলের পাইপের কোনো অংশের ছিদ্র দিয়ে গ্যাস বের হচ্ছিল। আর চুলার সুইচ অন করার সঙ্গেই দাহ্য গ্যাসে আগুন ধরে যায়। এ ঘটনায় তখন সাত-আটজন লোক অগ্নিদগ্ধ হন। বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. সামসুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সিলিন্ডারগুলো বিস্ফোরক বিভাগ থেকে পাঁচ বছর পর পরীক্ষা করার কথা থাকলেও তা করা সম্ভব হচ্ছে না, যা সিলিন্ডার বিস্ফোরণের অন্যতম কারণ। দুর্ঘটনা এড়াতে তিনি ভালো মানের এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার কেনার ওপর জোর দেন। তার মতে, নিয়মিত সিলিন্ডার গ্যাস পরীক্ষা করলে এতে কোনো দুর্বলতা আছে কি না তা চিহ্নিত করা যায়। সাধারণত আমদানি করা সিলিন্ডারগুলোর মান ভালোই হয়, কিন্তু ব্যবহারকারী এগুলো ব্যবহারে উদাসীন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের তথ্যে, প্রতি মাসেই ছোট-বড় মিলিয়ে এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ১৫ থেকে ২০ জন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সামন্তলাল সেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ কথা ঠিক যে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মানুষের দুর্ঘটনার হার আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা দেখছি যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের এ বিষয়ে সচেতনতার অভাব থাকায় দুর্ঘটনা ঘটছে। এ জন্য তিনি ব্যবহারকারীদের প্রতি ছয় মাসে সিলিন্ডারগুলো মনিটর করার ওপর জোর দেন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক আলী আহাম্মেদ খান বলেন, সাধারণত নিম্নমানের সিলিন্ডার এবং নিয়মিত পরীক্ষা না করার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। আবার ব্যবহারকারীদের মধ্যেও সিলিন্ডার নিয়মিত পরীক্ষা করানোর বিষয়ে আগ্রহ নেই। তার মতে, এগুলো পর্যবেক্ষণের জন্য একটি রেগুলেটরি বডি থাকা উচিত। যেহেতু ক্রমেই এলপিজি সিলিন্ডারের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে এ জন্য এখনই এর সঙ্গে যুক্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর