বুধবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ক্যাপাসিটি-সাইকেল লসের চক্রে বিমান

দূরপাল্লার বিমান দিয়ে স্বল্প দূরত্বের ফ্লাইট পরিচালনায় বাড়ছে ক্ষতি, সিভিল এভিয়েশনকে দায়ী করছে বিমান

নিজস্ব প্রতিবেদক

ক্যাপাসিটি-সাইকেল লসের চক্রে বিমান

দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে সক্ষম উড়োজাহাজ দিয়ে স্বল্প ও মাঝারি দূরত্বের ফ্লাইট পরিচালনা বিমানকে ক্যাপাসিটি এবং সাইকেল লসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বর্তমানে মাত্র ১৫টি আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে বিমান। এর মধ্যে লম্বা দূরত্বের রুট আছে মাত্র একটি, ঢাকা-লন্ডন। অথচ বিমানের বহরে নতুন প্রজন্মের এসব উড়োজাহাজ যুক্ত করার লক্ষ্য ছিল ইউরোপ-আমেরিকার মতো দীর্ঘ দূরত্বে ফ্লাইট চালানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রুট সম্প্রসারণ করা। গত আট বছরে বোয়িং থেকে বিমানের কেনা যে সাতটি উড়োজাহাজ বহরে যুক্ত হয়েছে, তার পাঁচটিই দীর্ঘ রুটের। আরও যে তিনটি উড়োজাহাজ বহরে যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে, তাও দীর্ঘ রুটে উড্ডয়নের জন্য। বহর পরিকল্পনার এ অদূরদর্শিতায় ভুগতে হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থাটিকে। ক্যাপাসিটি লসে পড়তে হচ্ছে বিমানকে। লম্বা দূরত্ব পাড়ি দিতে সক্ষম আটটি উড়োজাহাজ কিনতে বোয়িং কোম্পানির সঙ্গে ২০০৮ সালে চুক্তি করে বিমান। এর মধ্যে চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর ২০১১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বহরে যুক্ত হয়। গত আগস্টে যুক্ত হয়েছে একটি বোয়িং ৭৮৭ ‘ড্রিমলাইনার’। আরও একটি ড্রিমলাইনার আসছে আগামী ৩০ নভেম্বর। প্রতিটি উড়োজাহাজই একটানা ১৬ ঘণ্টার বেশি উড়তে সক্ষম। বিমান সূত্রে জানা গেছে, উড়োজাহাজগুলোর ক্রয়াদেশ দেওয়ার সময় বিমানের আন্তর্জাতিক রুট ছিল ২২টি। কর্তৃপক্ষ আশা করেছিল, উড়োজাহাজগুলো বহরে যুক্ত হলে আরও নতুন নতুন গন্তব্যে ফ্লাইট চালানো সম্ভব হবে। যদিও ঘটেছে এর উল্টো। বহরে প্রথম বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর (পালকি) উড়োজাহাজটি যুক্ত হওয়ার পর ২০১২ সালে পুনরায় ম্যানচেস্টার রুটের ফ্লাইট চালু করে বিমান। উড়োজাহাজ সংকটে যা দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল। তবে হজ ফ্লাইট চালাতে গিয়ে উড়োজাহাজ সংকটে ওই বছর ১৯ অক্টোবর আবারও বন্ধ হয়ে যায় ম্যানচেস্টার রুটের ফ্লাইট, যা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি আজও। এ ছাড়া ঢাকা-রোম-ফ্রাঙ্কফুর্ট, ঢাকা-দিল্লি, ঢাকা-হংকং, ঢাকা-দুবাই-ব্রাসেলস-নিউইয়র্ক রুটের ফ্লাইটগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলেও নেওয়া হয়নি চালু করার নতুন উদ্যোগ। ২০০৮ সালে বোয়িং কোম্পানি থেকে উড়োজাহাজ ক্রয় চুক্তির সময় বিমানের পর্ষদে ছিলেন কাজী ওয়াহিদুল আলম। এই এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ১৬ ঘণ্টা উড়তে সক্ষম উড়োজাহাজ দিয়ে ৬ ঘণ্টার ফ্লাইট পরিচালনায় বাড়ছে ক্যাপাসিটি লস এবং ইঞ্জিন লসের পরিমাণ। শুধু তাই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ার এবং কমছে লাইফ সাইকেল। দূরপাল্লার এসব উড়োজাহাজ ছয় ঘণ্টার কম উড্ডয়ন করলে সেখানে যান্ত্রিক ত্রুটি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। এগুলো অনেক বেশি ক্ষতির কারণ হবে বিমান বাংলাদেশের জন্য। তিনি আরও বলেন, বিমান কেনার চুক্তি হয়েছে ১০ বছর আগে অথচ এখনো বিমানের কোন রুটে মার্কেট ভালো সেটা যাচাই-বাছাই না করা কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নয়। যে রুটে ১৭০ সিটের ফ্লাইট পরিচালনা করা হতো সেখানে হঠাৎ করে ২৮০ সিটের ফ্লাইট পরিচালনা করা অর্থনৈতিক এবং রাজস্ব আয়ের প্রশ্ন হিসেবে ভালো সিদ্ধান্ত নয়। বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ দিয়ে আপাতত লন্ডন রুটে ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়ানো হবে। এ ছাড়া গুয়াংজু, কলম্বো, মালে রুটেও ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে। কুয়েত, মদিনা, দিল্লি, হংকং ও টোকিওতে ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা আছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ বহরে আরও দুটি বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ যুক্ত হলে কলম্বো ও মালে রুট চালু করা হবে। বিমান সূত্রে জানা যায়, ৮ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে আটটি উড়োজাহাজ ক্রয়ে ২০০৮ সালে বোয়িংয়ের সঙ্গে চুক্তি করে বিমান। এর মধ্যে রয়েছে চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর ও চারটি বোয়িং ৭৮৭-৮ (ড্রিমলাইনার) উড়োজাহাজ। পরবর্তী সময়ে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের আরও দুটি উড়োজাহাজের ক্রয়াদেশ দেয় বিমান। ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আনা হয় চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ। এগুলোর নাম রাখা হয় পালকি, অরুণ আলো, আকাশপ্রদীপ ও রাঙা প্রভাত। ২০১৫ সালের নভেম্বরে আনা হয় বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের নতুন আরও একটি উড়োজাহাজ; যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘মেঘদূত’। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বিমানের বহরে যোগ হয়েছে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ ‘ময়ূরপঙ্খী’। সর্বশেষ গত আগস্টে যুক্ত হয়েছে একটি বোয়িং ৭৮৭ ‘ড্রিমলাইনার’। আগামী বছর আরও একটি অত্যাধুনিক উড়োজাহাজ যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। এ ব্যাপারে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) শাকিল মেরাজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, উড়োজাহাজে সিট ফাঁকা গেলে সেটাকে ক্যাপাসিটি লস বলা হয়। নতুন উড়োজাহাজ দিয়ে আমরা যেসব রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছি সেখানে আমাদের প্রচুর যাত্রী চাহিদা রয়েছে। তাই ক্যাপাসিটি লসের কোনো সুযোগ নেই। তবে সাইকেল লস রয়েছে। অল্প সময়ে ল্যান্ডিং করায় বিমানের ইঞ্জিনের সাইকেল লস বাড়ছে। তাই ঢাকা-লন্ডন রুটে আরেকটি ফ্লাইট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আমেরিকার ফ্লাইট পরিচালনার অনুমোদন না পাওয়ার বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনকে দায়ী করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকা) মানদণ্ডে ২ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করছে। এ জন্য আমেরিকার আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি নেই আমাদের। তারা যত দিন ক্যাটাগরি ১-এ উন্নীত হতে না পারবে তত দিন আমরা আমেরিকায় ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারব না। তাই সিডনিতে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য সিঙ্গাপুর দিয়ে যাওয়ার একটা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিমানের অন্য ফ্লাইটগুলোর মতো আশা করি এটাও লাভজনক হবে।

সর্বশেষ খবর