বৃহস্পতিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

পিছিয়ে নেই তরুণীরা

মির্জা মেহেদী তমাল

পিছিয়ে নেই তরুণীরা

নারী হওয়ায় কেউ সন্দেহ করবে না— এমন বিশ্বাসে সিরাজগঞ্জের একটি টিনশেড বাসা ভাড়া নিয়ে সপরিবারে খুব গোপনে দলে নতুন সদস্য বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছিলেন চার নারী। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি তাদের। এক গভীর রাতে সেই বাসায় সাংগঠনিক গোপন বৈঠক করার সময় ওই চার নারীকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এরপর ঘরে তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া যায় ১৩টি জিহাদি বই, ৬টি তাজা ককটেল ও ৪টি গ্রেনেড তৈরির খোল এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম। পুলিশের দাবি, এ চার নারী নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্য। সিরাজগঞ্জ জেলা শহরের মছিমপুর মহল্লার হুকুম আলীর ভাড়া দেওয়া টিনশেড বাড়ি থেকে তাদের আটক করা হয়। বাড়ি ভাড়া নিয়ে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে জেলা শহর ও আশপাশের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের মধ্যে ধর্ম প্রচারের নামে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছিলেন তারা। ২০১৬ সালের জুলাইয়ের ঘটনা এটি। একই বছর ১৬ আগস্ট রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে জেএমবির আরও চার নারী সদস্যকে আটক করে র‌্যাব। এরা হলেন আকলিমা রহমান, মৌ, মেঘনা ও ঐশী। এর মধ্যে তিনজনই মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের শিক্ষার্থী। আরেকজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ইন্টার্ন (শিক্ষানবিস) চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলের আমির মাহমুদুল হাসানের দেওয়া তথ্যে র‌্যাব এ চারজনকে গ্রেফতার করে। এর মধ্যে প্রথম তিনজনই নরসিংদীর জঙ্গি আস্তানায় ছিলেন। গত দুই দিনের অভিযানে এদের দুজন আত্মসমর্পণ করেন। অন্যজন নিহত হন। র‌্যাব জানায়, ঐশী ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে এমবিবিএস সম্পন্ন করে জুন থেকে হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার বাবা-মা দুজনই চিকিৎসক। ঐশী ২০১৩ সাল থেকে জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। নারী দলটির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ ঐশী অথবা আকলিমা রহমান নিতেন। আকলিমা রহমান রাজধানীর উত্তরা হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও হলি সাইন্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ২০১৩ সালে তিনি মানারাত ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মাসি বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি আকলিমা আরবি অধ্যয়নে বিভিন্ন স্থানে যেতেন এবং সেখানে দাওয়াতের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। নতুন ধারায় জঙ্গিবাদে উৎসাহ প্রদান করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ১৫ আগস্ট রাতে গাজীপুরের সাইনবোর্ডে তার নিজ বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। মৌ ২০১৫ সাল থেকে জিহাদি কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলেন। মৌ ২০১৩ সালে মানারাত ইউনিভার্সিটিতে ফার্মাসি বিষয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। বর্তমানে অনার্স শেষ বর্ষ সপ্তম সেমিস্টারে অধ্যয়নরত। মেঘনা ঢাকা ক্যামব্রিয়ান কলেজ থেকে ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করেন। ২০১৬ সালে প্রথম তাকে গ্রেফতার করা হয় রাজধানীর মিরপুর-১, জনতা হাউজিংয়ের সামনে তার ভাড়া করা সাবলেট বাসা থেকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধর্মপ্রাণ সহজ-সরল মানুষের কাছে তারা ধর্মের বাণী প্রচার করতেন। কিন্তু এর আড়ালে চালাতেন জঙ্গি তৎপরতা। নারী হওয়ায় কেউ সন্দেহ করবে না— এমন বিশ্বাসে তারা সাধারণ নারীদের মধ্যে মিশে যেতেন। ধর্মের বাণী প্রচার করতে গিয়ে তারা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে সহজ-সরল নারীদের বিপথগামী করেছেন। শিক্ষিত, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণীরা এ কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। নিষিদ্ধ সংগঠন জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসার আল-ইসলামসহ জঙ্গি গ্রুপগুলোয় আত্মঘাতী নারী জঙ্গিদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আবার নারী হওয়ার কারণে অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের কম সন্দেহ করেন। এ সুযোগ জঙ্গিরা কাজে লাগাচ্ছে। তারা ইসলামের নামে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত করছে। উগ্র জঙ্গিরা নানাভাবে নারীদের টার্গেট করে জঙ্গিবাদের সদস্য করছে। জানা গেছে, নারীদের বিষয়ে অনেক পুলিশের এখনো দুর্বল ধ্যান-ধারণা থাকায় উগ্র জঙ্গিরা নারীদের টার্গেট হিসেবে বেছে নিয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসছে। এ ছাড়া পুরুষ উগ্রবাদীদের অনেক তথ্য-উপাত্ত পুলিশের কাছে রয়েছে। তার তুলনায় নারী উগ্রবাদীদের সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত নেই বললেই চলে বা ধারণা করা হয়। সেই সুযোগ উগ্রবাদীরা গ্রহণ করছে। উগ্রবাদীদের এ কৌশল অঙ্কুরে বিনষ্ট না করা গেলে নতুন ধরনের উগ্রবাদী ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে; যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে। একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার মতে, দেশের বিভিন্ন জেলা ও গ্রামগঞ্জের কম শিক্ষিত ও দরিদ্র পরিবারকেন্দ্রিক নারীরা নানাভাবে প্রভাবিত হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। অনেকেই সহজ-সরল নারীদের প্রথমে ধর্মের কথা বলে কাছে টেনে নেয়। এরপর তারা কৌশলে আস্তে আস্তে নারীদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে। আবার অনেকের স্বামী জঙ্গি হলে স্বাভাবিক কারণে তার স্ত্রীসহ পরিবারের সন্তানরা নিজেদের অজান্তে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিষিদ্ধ সংগঠন জেএমবি ও হিযবুত তাহ্রীর এখন অনেক বেশি নির্ভর করছে তাদের নারী সংগঠকদের ওপর। বেশ কিছুদিন থেকেই নতুন রিক্রুটমেন্ট বা গোপন সভার খবরাখবর দেওয়ার কাজ নারীদের দিয়েই করানো হচ্ছে। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে নেতা-কর্মীরা গা-ঢাকা দিয়ে নারীদের দিয়ে সাংগঠনিক কাজগুলো সক্রিয় রাখছেন। সমাজ বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একসময় সঠিক ইসলামের জন্য নারীরা জীবন দিয়েছেন। সেসব নারীর বীরত্বগাথা কাহিনীর অপব্যাখ্যা দিয়ে মেয়েদের ভুল পথে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এ মুহূর্তে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বা এর থেকে দূরে রাখতে এবং যারা জড়িয়ে পড়েছে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, সঠিক ইসলামের জন্য একসময় নারীদের জীবন দেওয়ার ঘটনা আছে। এ ধরনের কাহিনী বলে মেয়েদের ভুল পথে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। তবে সেই সময়ের প্রেক্ষাপট আর এখন এক নয়। এখন ভুল করা হচ্ছে। সে সময়ের নারীদের বীরত্বগাথা এখনকার মেয়েদের ভুলভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে শোনানো হচ্ছে। এতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে তরুণীরা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর