শুক্রবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভাই একটু শুনবেন

মির্জা মেহেদী তমাল

ভাই একটু শুনবেন

‘ভাই একটু শুনবেন’— বলতে বলতে কাছে এসে পথ আগলে দাঁড়ান এক তরুণী। তার মাথায় একটা ছোট ব্যান্ডেজ। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চেহারায় বিষণ্নতা। তরুণী বলেন, ‘আমি ইডেন কলেজের ছাত্রী। আমি আর আমার বাবা ঢাকায় আসার পথে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছি। আমার আঘাত সামান্যই। বাবা এখন ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে। আমার ভাইয়া রংপুর থেকে রওনা হয়েছেন খবর শুনে। কিন্তু এখন আর যোগাযোগ করতে পারছি না। ওর মোবাইল ফোনে মনে হয় চার্জ নেই। কিন্তু আমি সমস্যায় পড়ে গেছি ভাইয়া।’ কথা শেষ না করেই দীর্ঘশ্বাস টানে তরুণী। এরপর আবারও বলতে থাকে। তার বাবার জন্য ওষুধ কিনতে হবে। মাত্র ১০০ টাকা এখন তার কাছে। আর কোনো টাকা নেই। কিন্তু ডাক্তার যে ওষুধ দিয়েছে, তাতে করে আরও ৫০০ টাকার প্রয়োজন। রাজধানীর তোপখানা রোডে দাঁড়িয়ে এভাবেই কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। ওষুধের ব্যবস্থা করে দেওয়া যাবে জানিয়ে প্রথমে তার বাবার সঙ্গে দেখা করার কথা বললে তরুণী জানায়, কোনো সমস্যা নেই। সে তার অসুস্থ বাবার কাছে নিয়ে যাবে। তবে ওষুধ কিনে যেতে হবে। আগে টাকা চায় তরুণী। ঢাকা মেডিকেলের সামনে ফার্মেসি আছে সেখান থেকে ওষুধ কেনা যাবে বলে তরুণীকে সেদিকে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে সে সম্মত হয়। হাঁটতে থাকে ধীরে ধীরে। এ সময় তার বাবার নাম জানতে চাইলে সে জানায়, ফজলুল হক। আর ভাইয়ের নাম কিরণ। তার ভাইয়ের বিস্তারিত পরিচয় জানার চেষ্টা করলে বিরক্ত হয় তরুণী। তার ভাইয়ের ফোন নম্বর চাইলে হঠাৎ ক্ষেপে যায়। অস্থিরভাবে এদিক সেদিক চায়। জানায়, অবিশ্বাসীর কোনো সহযোগিতা তার প্রয়োজন নেই। বারবার অনুরোধ করলেও দ্রুত শহীদ মিনার এলাকা দিয়ে একটা রিকশা ডেকে চলে যায় ওই তরুণী। তাত্ক্ষণিকভাবে ঢাকা মেডিকেলে ছুটে গিয়ে জরুরি বিভাগে ফজলুল হক নামে ওই রোগীর খোঁজ করে তার কোনো হদিস মিলেনি। রাজধানীতে এরকম ঘটনা ঘটছে অহরহ। বিপদগ্রস্ত হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করলেও তারা মূলত এক শ্রেণির প্রতারক। অনেক সময় তাদের ধোঁকায় পড়ে আর্থিক সহযোগিতা করেন সহজ সরল মানুষ। একইভাবে মৌচাক এলাকায় মাঝে মধ্যে বোরকা পরা চল্লিশোর্ধ্ব বছর বয়সী এক নারী ও তার দুই শিশু সন্তানকে দেখা যায়। তাদের সঙ্গে থাকে একটি ব্যাগ। বিশেষ করে সন্ধ্যার পরপরই তারা এই কাজে রাস্তায় নামেন। মৌচাক মোড়ে সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ দেখলেই টার্গেট করে এগিয়ে যান। অসহায়ের মতো পথ আগলে দাঁড়িয়ে নিজের সমস্যার কথা বলেন। প্রতিবার একই সমস্যার কথা জানান এই নারী। ওই নারীর কথানুসারে, তার বাড়ি ভোলায়। বড় ছেলেটা বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে ঢাকায়। শুনেছেন মিরপুরে একটি গার্মেন্টে চাকরি করে। কিন্তু খুঁজে পাননি। ছেলের কোনো মোবাইল ফোনও নেই। হাতে যা টাকা ছিল তা খরচ হয়ে গেছে। এখন রাত হয়ে যাচ্ছে। কোথায় থাকবেন, কী খাবেন বুঝতে পারছেন না। প্রায় আট বছর বয়সী ছেলেকে দেখিয়ে বলেন, দেখেন বাবাজি ছেলেটা ক্ষুধার জ্বালায় ক্যামন হয়ে গেছে। আমাদের একটু সাহায্য করেন। আমরা বাড়িতে চলে যাব। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই নারীর নাম পাপিয়া। থাকেন রাজধানীর মিরপুর বস্তিতে। স্বামী একজন ভ্যানচালক। দুই সন্তান নিয়ে প্রায় এক বছর ধরে ওই বস্তিতে আছেন তিনি। প্রতিবেশীরা জানান, প্রায়ই বিকালে বোরকা পরে দুই সন্তানকে নিয়ে বস্তি থেকে বের হয়ে যান। ফিরেন রাত ১০টার দিকে। এ বিষয়ে ওই নারীর মুখোমুখি হলে তিনি স্বীকার করে জানান, পেটের দায়ে এরকম প্রতারণা করেন তিনি। একেকদিন একেক স্থানে অবস্থান নিয়ে সহযোগিতার নামে প্রতারণা করেন তিনি। এটাকে অপরাধ মনে করেন না এই নারী। একইভাবে দীর্ঘদিন থেকে গাবতলী, কমলাপুর, সায়েদাবাদ ও সদরঘাটে অভিন্ন প্রতারণা করে যাচ্ছে মুনিরা, আলেয়া, আছমাসহ বেশ কয়েক নারী। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন এতে প্রকৃত বিপদগ্রস্তরা সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হবে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, এটি একটি অপরাধ। নৈতিক শিক্ষার অভাবেই এ ধরনের প্রতারণা করা হচ্ছে। এতে করে সহযোগিতাকারীদের অবিশ্বাস সৃষ্টি হবে। ফলে প্রকৃত বিপদগ্রস্তরা সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। এজন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্রকৃত বিপদগ্রস্তদের চিনে সহযোগিতা করতে হবে বলে জানান তিনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর