শনিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

রাজপথে তল্লাশি চক্র

মির্জা মেহেদী তমাল

রাজপথে তল্লাশি চক্র

ব্যবসায়ী এটি এম ফরহাদ। অফিসের কাজ শেষে সিএনজিচালিত অটো রিকশায় চড়ে গুলশান থেকে যাত্রাবাড়ী মীরহাজিরবাগের বাসায় ফিরছিলেন। লিঙ্করোডের কাছাকাছি পৌঁছলে পেছন থেকে দ্রুতগতির একটি মাইক্রোবাস তাদের সামনে এসে থামে। মাইক্রোবাসে বসে থাকা ব্যক্তিরা তাদের থামার সংকেত দেন। চালক রাস্তায় সাইড করে অটো থামান। মাইক্রোবাস থেকে ৪ ব্যক্তি নেমে এসে অটোটি ঘিরে ফেলে। তাদের হাতে ছিল ওয়াকিটকি, মোটা লাঠি। এরা প্রত্যেকেই ছিল সাদা পোশাকে। পুলিশ লেখা জ্যাকেটও ছিল একজনের গায়ে। তারা প্রথমে সিএনজির কাগজপত্র দেখতে চান চালকের কাছে। চালক কাগজপত্র দেখায়। কাগজপত্র সব ঠিকঠাক ছিল। এরপর তারা ফরহাদকে সিএনজি থেকে নামিয়ে দেহ তল্লাশি করে। ফরহাদের পকেটে এ সময় ব্যবসার দুই লাখ টাকা ছিল। ওই ব্যক্তিরা পকেটে হাত দিয়ে টাকার খোঁজ পান। তারা ফরহাদকে টাকার কথা জিজ্ঞাস করে। ফরহাদ তাদের বলেন, টাকাগুলো অফিসের। এ সময় ওই ব্যক্তিরা ফরহাদকে টেনেহিঁচড়ে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। এ সময় আশপাশে অসংখ্য লোক এ দৃশ্য দেখলেও পুলিশ বলে কেউ এগিয়ে আসেনি। দুই দিন পর ফরহাদকে অর্ধমৃত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া  যায় কালিয়াকৈর-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশের একটি ঝোপ-ঝাড় থেকে। ফরহাদ বলেন, মাইক্রোবাসে উঠেই চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় আরও এক ব্যক্তিকে দেখতে পাই। চোখ বাঁধা লোকটি সিটের নিচে বসে ছিল। এরপর আমার চোখও বেঁধে দেওয়া হয়। আমি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তারা আমাকে হত্যার হুমকি দেয়। চোখ ও হাত বেঁধে আমাকেও সিটের নিচে বসিয়ে রাখে তারা। মাইক্রোবাসও চলতে থাকে। এক পর্যায়ে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানালে আমাকে মাথার পেছনে আঘাত করা হয়। এরপর বুঝতে পারি আমার শরীরে ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে। আমার বমি আসছিল। সম্ভবত আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তিনি বলেন, এক সময় চোখ মেলে অস্পষ্ট কিছু দেখছিলাম। ওই সময়টা সন্ধ্যা বা রাত হবে। এরপর আবারও শরীরে পর পর ২টা ইনজেকশন পুশ করার কষ্ট পাই। বুঝতে পারি ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে। এরপর আমি কিছু মনে করতে পারছিলাম না। এরপর আমি যখন চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করি, বুঝতে পারি আমি কোনো গাড়িতে রয়েছি। বুঝতে পারছিলাম ওই সময় রাত। চলন্ত মাইক্রোবাসের দরজা খুলে ফেলে ওরা। আমাকে ধরে দরজার সামনে নিয়ে ধাক্কা দেয়। আমি চলন্ত গাড়ি থেকে ছিটকে পড়ি। গড়িয়ে গড়িয়ে কোথায় যাচ্ছি, বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ আমি বুঝতে পারি, আমি কোনো ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে আটকে আছি। চারদিক শুধু অন্ধকার। পুরো শরীর ব্যথা। চোখ খুলতে পারছিলাম না। আমি হামাগুড়ি দিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকি। বুঝতে পারি কোনো সড়কের ওপর আমি তখন। দূরে একটি দোকানের মতো দেখতে পাই। আলো জ্বলছিল। সেখানটায় যেতে থাকি হামাগুড়ি দিয়ে। দোকানের কাছাকাছি যেতেই আমি রাস্তায় শুয়ে পড়ি। চোখ খুলে দেখি আমার মাথায় কেউ পানি ঢালছে। যে দোকানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, সেই দোকানের লোকজনই আমার মাথায় পানি ঢালছিল। সেই দোকানদার আমার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রাণে রক্ষা পাই। তবে আমি তাদের কথাবার্তায় বুঝতে পারছিলাম, আমাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ আটকে রাখেনি। এরা সন্ত্রাসীচক্র। যদিও আমাকে যখন তুলে নেয়, নিজেদের পুলিশ পরিচয় দিয়েছিল।

রাজধানীতে এমন একটি ভয়ঙ্কর চক্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যারা পুলিশ পরিচয়ে যানবাহনে তল্লাশি চালায়। এরা শিকারের খোঁজে মাইক্রোবাস নিয়ে নগরীর রাজপথে ঘুরে বেড়ায়। ভাব ভঙ্গি তাদের পুলিশের। হাতে তাদের ওয়াকিটকি, মোটা লাঠি। মাইক্রোবাসের ভিতর চোখ বাঁধা মানুষও থাকে। ব্যস্ততম সড়কে প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশার গতিরোধ করে তল্লাশি চালায়। পছন্দ হলেই সুযোগ মতো গাড়ি বা অটোর যাত্রীকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। অপহৃত যাত্রীদের কখনো খোঁজ মিলে দুর্গম কোনো এলাকায়। আবার অনেকের লাশও খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনই বেশ কয়েকটি ঘটনা রাজধানীতে প্রকাশ্যে ঘটার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ভাবিয়ে তুলেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, রাজধানীতে এমন বেশ কয়েকটি অপরাধী চক্র রয়েছে। এরা পুলিশ পরিচয়ে নানা অপরাধ করছে। এমন একটি চক্রের কাজই হলো মুক্তিপণ আদায় করা। রাস্তা বা যানবাহন তল্লাশির নামে যাত্রীকে তুলে নেয় তাদের নিজস্ব যানবাহনে। এরপর তারা পরিবারের কাছে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করে থাকে। এরা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এরা যাদের তুলে নিয়ে যায়, তাদের প্রাণ নিয়ে ফিরে আসাটাই সৌভাগ্যের বিষয়। মুক্তিপণ ছাড়া অপহৃতদের উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়ে। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক নানা কর্মসূচিতে রাজপথে পুলিশের তৎপরতা বাড়ে। ধরপাকড় শুরু হয়। এই সুযোগে অপরাধী চক্রটিও রাজপথে দাপিয়ে বেড়াতে থাকে। প্রকাশ্যে কাউকে মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হলেও পুলিশ ভেবে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসে না। পুলিশের পরিচয় ব্যবহার করে অভিনব কায়দায় প্রতারণা করে যাচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। এদের হাতে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এর ফলে পুলিশেরও সম্মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তাই এই চক্রের অপতৎপরতা ঠেকাতে কঠোর ভূমিকায় নেমেছে পুলিশ। একই সঙ্গে জনগণকে এদের ব্যাপারে সচেতন হওয়ারও অনুরোধ জানানো হয়েছে পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলের পক্ষ থেকে। কিন্তু, কীভাবে চেনা যাবে এসব ভুয়া পুলিশকে? এ বিষয়ে কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা বলেন, ভুয়া পুুলিশের ব্যবহৃত ওয়াকিটকি চালু আছে কিনা লক্ষ্য রাখতে হবে। ভুয়া পুলিশ সদস্যদের ওয়াকিটকি কখনো চালু থাকে না এবং কোনো শব্দও পাওয়া যায় না। কারণ সেটি খেলনা ওয়াকিটকি। সাদা পোশাকে পুলিশ কোনো অভিযান পরিচালনা করলে অবশ্যই গায়ে জ্যাকেট পরে নেয় ও গলায় পরিচয়পত্র ঝোলানো থাকে। কিন্তু ভুয়া পুলিশ সদস্যরা বেশির ভাগ সময় কোনো ধরনের জ্যাকেট বা পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখে না। ভুয়া পুলিশ চক্র সব সময় খেলনা পিস্তল ব্যবহার করে, তারা কখনই লং আর্মস : যেমন শটগান বা এসএমজি সঙ্গে রাখে না। গতিবিধি ও আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ভুয়া পুলিশ প্রথমেই টাকা, অলঙ্কার ও মূল্যবান মালামাল নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের আচরণে উগ্রতা ও রুক্ষভাব থাকে। এই চক্রের সদস্যদের পারস্পরিক কথোপকথনেও স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, এরা আসল না নকল। এরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে এবং চোর ডাকাতের মতো আচরণ করতে থাকে। কর্মকর্তারা বলেন, এমন ভুয়া পুলিশের ঝামেলায় পড়লে বা মুখোমুখি হলে কৌশলে নিকটস্থ থানা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অবহিত করতে হবে। যদি শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায় যে এরা ভুয়া পুলিশ সদস্য এবং ব্যবহৃত অস্ত্রটিও খেলনা তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সাহসিকতার সঙ্গে তাদের প্রতিহত করে পুলিশকে খবর দিতে হবে। ৯৯৯ নম্বরেও ফোন করা যেতে পারে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর