শিরোনাম
রবিবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

আমি সাংবাদিক বলছি

মির্জা মেহেদী তমাল

আমি সাংবাদিক বলছি

ফোন আসে জেলা প্রশাসকের কাছে। তিনি ফোন ধরে হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে এক ভদ্রলোক নিজেকে দেশের একটি শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক পরিচয় দেন। সাংবাদিকের নাম পরিচয় জেনে জেলা প্রশাসক বলেন, আপনার নাম শুনেছি অনেক। আজ কথা হলো। ওই সাংবাদিক কাজের কথা শুরু করেন। জেলা প্রশাসকের কাছে তিনি বড় একটি টেন্ডার পাইয়ে দেওয়ার আবদার করেন। এ কথা শুনে জেলা প্রশাসক বলেন, নিয়মমতো করে টেন্ডারের কাজ হয়। সর্বনিম্ন দরদাতা হলে অবশ্যই কাজ পাবেন। কিন্তু ওই সাংবাদিক এতে ক্ষুব্ধ হন। বলেন, আপনি কাজটা ভালো করছেন না। টেন্ডারের জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে । এক কথায় দুই কথায় তাদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়। ওই সাংবাদিক একপর্যায়ে জেলা প্রশাসককে হুমকি দেন। বলেন, আমাদের কাছে আপনার দুর্নীতির অনেক কাগজপত্র আছে। ইচ্ছা করলে আপনার চাকরি ধরে টান দিতে পারি। হয় কাজ পাইয়ে দিতে হবে, নয়তো ক্যাশ ছাড়তে হবে। এসব শুনে জেলা প্রশাসক যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বলে কী লোকটা? ক্যাশ দিতে হবে মানে! সাংবাদিকের সাফ কথা। দিতে হবে টাকা। তিনি একটি বিকাশ নম্বর দিয়ে বলেন, তাড়াতাড়ি ওই নম্বরে যেন টাকা পাঠিয়ে দেন। তবে সাংবাদিকের কথাবার্তায় জেলা প্রশাসকের সন্দেহ হয়। তিনি ওই পত্রিকায় ফোন দেন। সাংবাদিকের নাম বলেন। পত্রিকা থেকে বলা হয়, এই নামের সাংবাদিক আছেন। তিনি আসবেন সন্ধ্যায়। জেলা প্রশাসক ভীষণ টেনশনে পড়ে গেলেন। ভাবছেন, উল্টাপাল্টা আবার কিছু লিখে দেয় কি-না! তিনি সন্ধ্যায় আবারও ফোন দেন সেই পত্রিকা অফিসে। সেই সাংবাদিককে পেয়ে যান। ফোনে কথা বলেন। বলেন, ভাই কিছু মনে করবেন না। আপনি যে টেন্ডারের কথা বলেছেন, তা এখন দেওয়া সম্ভব নয়। সাংবাদিক এ কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। বলেন, কী বলছেন ভাই। আমি আপনাকে ফোন দেব কেন। আর আমি তো ব্যবসা করি না। টেন্ডার নিয়ে কী করব? পুরো বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা বলে তারা বুঝতে পারেন সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে প্রতারক এ কাজ করেছেন। একই জেলার টিএনও-কেও একই নম্বর দিয়ে ফোন করে টাকা দাবি করা হয়েছে।

উত্তরা এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হবে। পুলিশের প্রস্তুতি চলছে। অভিযানের আগ মুহূর্তে উত্তরা জোনের ডিসির কাছে ফোন আসে। শীর্ষ স্থানীয় একটি পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিকের পরিচয় দিয়ে কথা বলেন। ওই সাংবাদিক ডিসিকে বলেন, উত্তরা এলাকার একজন চিকিৎসকের বাসায় হানা দিলেই ইয়াবা পাওয়া যাবে। সাংবাদিকের এমন তথ্যে পুলিশের অভিযানে কিছুটা পরিবর্তন আসে। অভিযানের আগে পুলিশের বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে চিকিৎসকের বাসা, চেম্বারে অভিযানের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। এমন সময় পুলিশের অন্য কর্মকর্তারা বলেন, এই চিকিৎসক পরিচিত চিকিৎসক। হার্টের একজন স্বনামধন্য ডাক্তার। আরও একটু যাচাই-বাচাই করা দরকার। ওই সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পত্রিকা অফিসে ফোন দেওয়া হলে সাংবাদিককে পাওয়া যায়। তখন ওই সাংবাদিক জানান, তিনি তাকে ফোন দেননি কোনো বিষয়ে। পুলিশ তখনই বুঝতে পারে, এটি প্রতারক চক্রের কাজ।

মিরপুরের ব্যবসায়ী করিমের কাছ থেকে সাংবাদিক পরিচয়ে হাতিয়ে নিয়েছে পাঁচ লাখ টাকা। এরপরই সেই ব্যবসায়ী পত্রিকা অফিসে এসে ওই সাংবাদিকের খোঁজ করেন। একই নামের সাংবাদিককে তিনি পান ঠিকই, টাকা নিয়ে যাওয়া একই নামের সেই সাংবাদিকের খোঁজ পায় না। তখন বুঝতে পারে, প্রতারক চক্রের কাজ।

শুধু এ কটি ঘটনাই নয়। এমন ঘটনা ঘটছে নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে। একটি ভয়ঙ্কর প্রতারক চক্র পত্রিকার সাংবাদিকদের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন লোকজনকে ভয়ভীতি দেখায়। এমন একটি চক্রের প্রধান দুই সদস্যকে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করে। গত সপ্তাহে মিরপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার হওয়া প্রতারক নেয়ামত উল্যাহ শিমুল ও সয়নকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরা চাঞ্চল্যকর সব তথ্য দিয়েছে পুলিশের কাছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গ্রেফতার দুই ভুয়া সাংবাদিক শয়ন ও শিমুলকে একটি প্রতারক চক্র ‘নিয়োগ’ দেয়। তারা নিজেদের বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানী সেলের রিপোর্টার বলে পরিচয় দিতেন। এরা দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। তাদের অন্যতম কৌশল হচ্ছে উচ্চ শ্রেণি-পেশার মানুষকে মাদক ব্যবসায়ী, নাশকতায় জড়িত, জঙ্গি মদদদাতা আখ্যা দিয়ে হয়রানিমূলক প্রতিবেদন করে বিভিন্ন অখ্যাত সাপ্তাহিক ও অনলাইনে সংবাদ ছাপিয়ে প্রথমে তারা চাঁদাবাজি করে, পরে হুমকি দেয়, ‘আমরা যে অঙ্কের টাকা চাই তা এখনই দাও, নইলে বাংলাদেশ প্রতিদিনেও তোমাদের বিরুদ্ধে নিউজ করা হবে।’

মিরপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ওয়াহিদুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিমুল, শয়নসহ অজ্ঞাত আরও সাত-আট ব্যক্তি বহুল প্রচারিত বাংলাদেশ প্রতিদিনের ভিজিটিং কার্ড ও আইডি কার্ড তৈরি করে নিজেদের ওই পত্রিকার সাংবাদিক পরিচয় দেন। এ ছাড়া তারা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের হুমকি দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায়ের পর আত্মসাৎ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১০ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১০টায় মিরপুরের জনৈক করিম মিয়ার কাছ থেকে তারা ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।

অভিযান পরিচালনাকারী ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (পশ্চিম) জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ মাহমুদ হাসান বলেন, ‘গ্রেফতারকৃতরা একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সদস্য। মুখোশের আড়ালে এ চক্রের সঙ্গে জড়িত অনেক “নামি” মানুষও। অনেক প্রমাণ আমাদের কাছে এসেছে।’ সাংবাদিক নেতারা বলছেন, সাংবাদিকের কাজ ব্ল্যাকমেইলিং, ভয়ভীতি দেখানো নয়। এমন কেউ ভয়ভীতি বা ব্ল্যাকমেইলিং করার চেষ্টা করলে অবশ্যই ভুক্তভোগীকে সংশ্লিষ্ট পত্রিকায় খোঁজ নিতে হবে। পুলিশকে জানাতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর