বৃহস্পতিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

নির্বাচন সামনে রেখে উত্তপ্ত পাহাড়

বাড়ছে অবৈধ অস্ত্র ও নীরব চাঁদাবাজি

মানিক মুনতাসির, পার্বত্য অঞ্চল থেকে ফিরে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পার্বত্য অঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিকসহ সার্বিক পরিস্থিতি। ইউপিডিএফ, জেএসএসসহ পাহাড়ি সংগঠনসমূহের সশস্ত্র শাখাগুলো নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করছে। নির্বাচনে নিজেদের শক্ত অবস্থান জানান দিতে তারা অবৈধ অস্ত্রের মজুদ বাড়াচ্ছে। অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারও বেড়েছে এসব অঞ্চলে। রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি জেলা শহরসহ দুর্গম এলাকায় চলছে নীরব চাঁদাবাজি। এক হালি কলা এমনকি নারিকেল কিংবা ডাবের কাঁদি কিংবা একটি মুরগি বিক্রি করতে হলেও চাঁদা গুনতে হচ্ছে পাহাড়ে বসবাসকারীদের। এদিকে এলাকায় ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করতে তারা পর্যটকবাহী বাস কিংবা ট্রলারেও হামলা করছে। গত সপ্তায় রাঙামাটি ও বান্দরবানে এ ধরনের দুটি ঘটনা ঘটে। সেখানে পর্যটকবাহী বাস ও ট্রলার লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে একাধিক ব্যক্তিকে আহত করেছে সন্ত্রাসীরা। আহতদের চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সিএমএইচে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

এ প্রসঙ্গে ২২ অক্টোবর সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের পর্যটন জোনগুলোয় দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য সব ধরনের নিরাপত্তা দিচ্ছে সেনাবাহিনী। পাহাড়ি অঞ্চলে যারা বিশৃঙ্খলার ষড়যন্ত্র করছে তাদের এ ষড়যন্ত্র কখনই সফল হবে না বলে তিনি মনে করেন। সরেজমিন এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দাবিকৃত চাঁদা না দিলে নিরস্ত্র বাঙালিদের দিনদুপুরে গুম করে ফেলার ঘটনাও ঘটছে। এমনকি প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এসব সশস্ত্র গ্রুপের সদস্যরা। শুধু তাই নয়, পাহাড়ে বসবাসকারী নিরীহ উপজাতিরাও রেহাই পাচ্ছে না এদের অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে। তাদের কথামতো চাঁদা না দিলে কিংবা তাদের মনোনীত প্রার্থী বা কারবারিদের (স্থানীয় জনপ্রতিনিধি) কথামতো না চললেই তাদের প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর অভিযানে আধুনিক আগেয়াস্ত্রসহ ধরা পড়ছেন এসব গ্রুপের সামরিক শাখার সদস্যরা। অথচ ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তি অনুযায়ী শতভাগ অস্ত্র সমর্পণ করার কথা। কিন্তু এ চুক্তির ২১ বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ১০-১৫ শতাংশ অবৈধ অস্ত্র জমা দিয়েছে এসব সশস্ত্র সংগঠন। উল্টো প্রতিনিয়তই তারা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে নতুন করে অবৈধ অস্ত্রের মজুদ গড়ে সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে তথ্য উঠে এসেছে। গত কয়েক মাসে পার্বত্য এলাকাগুলোয় আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটেছে। সর্বশেষ গত ১০ মাসে এসব এলাকায় খুন হয়েছেন ৪০ জনের বেশি নিরস্ত্র মানুষ। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তার করতে গিয়ে নিজেরাই নিহত হয়েছেন একে অন্যের অস্ত্রের গুলিতে কিংবা আঘাতে। নির্বাচনী এলাকা ও নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে খুনোখুনিতেও জড়িয়ে পড়ছে এসব আঞ্চলিক সংগঠন। স্থানীয়রা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে চারটি আঞ্চলিক সংগঠন রয়েছে। তা হলো জেএসএস (সন্তু লারমা গ্রুপ), ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রুপ), জেএসএস (এম এন লারমা গ্রুপ) ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক গ্রুপ)। এসব সংগঠন নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে একের পর এক খুন, গুম, অপহরণসহ নানা ধরনের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে প্রতিনিয়তই। তবে তাদের টার্গেট শুধু প্রতিপক্ষ আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোই নয়, জাতীয় রাজনৈতিক মূলধারার দলও। এমনকি পাহাড়ি বাঙালিরা তাদের কথামতো না চললে ঘরবাড়ির মালামাল লুট করা হয়। পরে তাদের প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে জীবন্ত অবস্থায় গুম করে ফেলার ঘটনা ঘটাচ্ছে এসব সশস্ত্র গ্রুপ। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থী দিতে উপজাতি সংগঠনগুলোর এই সশস্ত্র কার্যক্রম অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। এ কাজে তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও প্রতিপক্ষকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছে।

গত ৩ মে রাঙামাটির নানিয়ার চর উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমাকে প্রতিপক্ষ ইউপিডিএফ (প্রসীত গ্রুপ) গুলি চালিয়ে হত্যা করে। ওই হত্যা মামলার চারজন আসামিকে চলতি সপ্তাহে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা সবাই এসব সশস্ত্র গ্রুপের সদস্য। আসামি ও স্থানীয়দেও দেওয়া তথ্যমতে, শক্তিমান চাকমা ছিলেন জেএসএস এম এন লারমা গ্রুপের সমর্থক। এলাকায় তার জনপ্রিয়তা ছিল অনেক। এজন্যই তাকে হত্যা করা হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শক্তিমান চাকমার অনুসারীরা যাতে সশস্ত্র গ্রুপের বিরোধী পক্ষের কোনো প্রার্থীকে সমর্থন দিতে না পারেন এজন্যই তাকে হত্যা করে আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছে বলে মনে করে স্থানীয় প্রশাসন। স্থানীয়রা জানান, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে পরিস্থিতি ততই ঘোলাটে হচ্ছে। উপজাতি সংগঠনগুলোর সশস্ত্র তৎপরতায় আতঙ্কের মধ্যে সময় পার করছে বাঙালি ও নিরীহ উপজাতিরা। এর আগে আওয়ামী লীগ করার অপরাধে খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার বর্মাছড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নীলবর্ণ চাকমাকে ২০১৬ সালের ২৯ নভেম্বর অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যায় ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের ১০-১২ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী। সেদিন খাগড়াছড়িতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের জনসভায় যোগ দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন নীলবর্ণ। তবে ভাগ্যক্রমে তিনি সেদিন প্রাণে বেঁচে যান। এখনো তাকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে জানা যায়। কিন্তু পার্বত্য তিন জেলায় এ রকম অনেকেই আছেন যারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা মূলধারার রাজনীতি করার অপরাধে অপহৃত হয়ে লাশ হয়ে ফিরেছেন। কেউ বা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন। অনেকেই আছেন যারা অপহরণের পর তাদের পরিবার এখনো জানে না তিনি বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন। বান্দরবানের আওয়ামী লীগ নেতা মংগ্রু মারমার ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে ২০১৬ সালের ১৩ জুন। রাঙামাটি জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে তার কার্যালয়ে ২২ অক্টোবর এই প্রতিবেদকের আলাপকালে তিনি দাবি করেন, অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় পার্বত্য অঞ্চলে চাঁদাবাজির ঘটনা কমেছে। কেননা তাদের কাছে কেউ অভিযোগ করে না। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, পুলিশবাহিনী পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর