মঙ্গলবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

দূষণে বিপর্যস্ত ঢাকার তিন লেক

আবর্জনায় ধুঁকছে হাতিরঝিল ও ধানমন্ডি লেক, সৌন্দর্য হারিয়েছে ক্রিসেন্ট লেক

জিন্নাতুন নূর

দূষণে বিপর্যস্ত ঢাকার তিন লেক

রাজধানীর হাতিরঝিল লেকের বিভিন্ন অংশে জমেছে ময়লা-আবর্জনা —জয়ীতা রায়

মানুষের বাসা-বাড়ির বর্জ্য, মলমূত্র, খাবারের প্যাকেট ও উচ্ছিষ্ট, পলিথিন ও রেস্টুরেন্টের বর্জ্যসহ বিভিন্ন প্রকার ময়লা-আবর্জনায় মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে ঢাকার তিন কৃত্রিম লেক। এগুলো বিশুদ্ধ বায়ু প্রাপ্তির স্থান তথা সুষ্ঠু বিনোদনকেন্দ্র হওয়ার কথা থাকলেও উল্টো ঘটনায় ঢাকাবাসী বিব্রত হচ্ছেন। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণা থেকে জানা গেছে, হাতিরঝিলের পানি মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। আর রেস্টুরেন্ট ও বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনায় ধানমন্ডি লেকের দূষণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। একই সঙ্গে শ্রীহীন হয়ে উঠেছে ঢাকার এক সময়ের বিখ্যাত ক্রিসেন্ট লেকও। 

খুব বেশিদিন হয়নি জনসাধারণের জন্য হাতিরঝিল প্রকল্প খুলে দেওয়া হয়েছে। অথচ এরই মধ্যে দৃষ্টিনন্দন লেকটির সৌন্দর্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছে। দূষণের কারণে সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্লাস্টিকবিরোধী নীতির অংশ হিসেবে ইইউ প্রতিনিধি দলের প্রধান ও রাষ্ট্রদূত রেঞ্চা টিয়েরিংকসহ ইইউ মিশনের প্রতিনিধিরা হাতিরঝিল পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে অংশ নেন। ইইউ দূতাবাস থেকে জানানো হয়, ‘হাতিরঝিলে প্লাস্টিক ও অন্য আবর্জনা ফেলায় সুন্দর লেকটি সমস্যায় পড়েছে।’ লেক সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির অংশ হিসেবে ইইউ মিশন সেখানে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালায়। এ সময় ১০ বস্তা পলিথিনের টুকরো উদ্ধার করা হয়। 

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, অব্যবস্থাপনার কারণেই মূলত রাজধানীর মনোমুগ্ধকর হাতিরঝিল দূষণের শিকার হচ্ছে। সরেজমিন হাতিরঝিলের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে শুধু যে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের প্যাকেট ও পলিথিন ফেলা হচ্ছে তা নয়। এর সঙ্গে আশপাশের বাসাবাড়ির ময়লা- আবর্জনা ও মলমূত্রও ফেলা হচ্ছে। বাসাবাড়ির পয়ঃনিষ্কাশনের নালা সরাসরি এসে হাতিরঝিলের পানিতে যুক্ত হয়েছে। ফলে স্থানে স্থানে লেকটির পানি কালো বর্ণ ধারণ করেছে। হাতিরঝিলের পানিতে ধানমন্ডি এলাকা থেকে পয়ঃনিষ্কাশনের পানি ঢুকছে। আর এই পানি হোটেল সোনারগাঁওয়ের পাশের পয়েন্ট দিয়ে বেগুনবাড়ি খালে প্রবেশ করছে। ফলে বিজিএমইএ ভবনের চারদিকে যে পানি, তা কালো বর্ণ হয়ে পড়েছে, যা পরে হাতিরঝিলে গিয়ে মিশছে। এ ছাড়া হাতিরঝিলের পুলিশ কনকর্ড প্লাজাসহ আশপাশের বিভিন্ন পয়েন্টে গড়ে ওঠা  রেস্টুরেন্টের ময়লা পানিতে ফেলায় সেখানকার পানিও দূষিত হয়ে পড়ছে।

এদিকে বিভিন্ন গবেষণার সুপারিশে বলা হয়েছে, বিভিন্ন উৎস থেকে আসা দূষিত পানি বন্ধ করতে না পারলে হাতিরঝিলের দূষণ কখনই বন্ধ করা যাবে না। প্রসঙ্গত, এরই মধ্যে হাতিরঝিলের দূষণ নিয়ে দেশের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গবেষণা করেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, হাতিরঝিলের পানিতে নানা ধরনের জীবাণুর অস্তিত্ব রয়েছে। এতে আরও বলা হয়, হাতিরঝিলের পানি মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এ পানিতে জীবাণুর ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি। মূলত সুয়ারেজের দূষিত পানি ঝিলের পানিতে     মিশে যাচ্ছে বলেই অল্প পরিমাণ পানিতে প্রচুর পরিমাণে জীবাণুু পাওয়া যাচ্ছে। বুয়েটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, হাতিরঝিলের পানিতে   রয়েছে প্রচুর পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড। এখানকার প্রতি লিটার পানিতে ৩৫ থেকে ৬০ মিলিগ্রাম কার্বন ডাই অক্সাইড আছে। অথচ আন্তর্জাতিক মান (ইসিআর-৯৭ স্ট্যান্ডার্ড) অনুযায়ী পানিতে কার্বন ডাই অক্সাইড থাকতে হবে প্রতি লিটারে ৪ গ্রাম মাত্র। এ ছাড়া পানির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যেমন— লৌহ ও ক্যালসিয়াম  কার্বনেটের পরিমাণও কম। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল এক ব্রিফিংয়ে জানান, হাতিরঝিলের পানি শোধনের জন্য একটি সমন্বিত টেকসই পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এটি বাস্তবায়ন করা হলে লেকের পানি দূষণ ও দুর্গন্ধমুক্ত হবে। মূলত বিদেশে পাঠানো হাতিরঝিলের পানির নমুনার রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ধানমন্ডি লেক : ধানমন্ডি লেকের আশপাশের বাসাবাড়ি ও এলাকার ময়লা-আবর্জনায় দিন দিন লেকটির পরিবেশ অত্যন্ত খারাপের দিকে যাচ্ছে। লেকের পানিতে অবাধে বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। ফলে পানিতে ভাসছে টিপসের প্যাকেট, ফোমের বাক্স, প্লাস্টিকের ব্যাগ, পলিথিন ইত্যাদি। এ কারণে লেকের পানি একদিকে যেমন দূষিত হচ্ছে, অন্যদিকে সেই পানিতে শ্যাওলা জমে তা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। 

ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার বাসিন্দারা সকাল-বিকাল এই লেকের পাশের ওয়াকওয়েতে নিয়মিত হাঁটেন। আবার বাইরে থেকেও নিয়মিত মানুষজন সেখানে বেড়াতে যান। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে দিন দিন এই লেকের পরিবেশও বিপর্যস্ত হচ্ছে।

সম্প্রতি লেকটি ঘুরে দেখা গেছে, বিজিবি উত্তর গেট থেকে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর পর্যন্ত সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ লেকের বিভিন্ন স্থানে ময়লা আবর্জনা জমে আছে। লেকটির বিভিন্ন পয়েন্টে সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজও চলছে। এতে ধানমন্ডি লেকটি তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারাচ্ছে। কলাবাগার ক্লাবের পেছনে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ জমে থাকতে দেখা গেছে। লেকের ব্যায়ামাগারের পেছনে ধানমন্ডি ১২-এ-এর সড়কটিতে অর্ধেক জায়গাজুড়েই বছরের পর বছর ধরে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ করছে। এর ফলে আশপাশের পরিবেশ মারাত্মক দূষণের কবলে পড়েছে। এ ছাড়া ধানমন্ডি লেকের ৩২ নং রোডের ব্রিজ থেকে ২৭ নং রোডের সাম্পান পর্যন্ত এলাকায় গৃহস্থালি বর্জ্য, পুরাতন বিল্ডিংয়ের ভাঙা অংশসহ নানা ধরনের বর্জ্য ফেলা হয়। লেকের ভিতরের কয়েকটি দ্বীপের রেস্টুরেন্ট থেকেও নিয়মিত খাবারের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সজীব বলেন, আমরা ক্লাস শেষে প্রতিদিনই এখানে আড্ডা দিতে আসি। লেকের পানি আগের মতো আর পরিষ্কার নেই। সেখান থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। এখানে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীরা বিভিন্ন প্রকার খাবারের প্যাকেট, বাদামের খোসা, ময়লা-আবর্জনা ফেলে লেক দূষণ করছেন। নগরবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকার কৃত্রিম লেকগুলোর দূষণ রোধে বেশ কিছু প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়ন করা না গেলে লেকগুলো দূষণমুক্ত করা যাবে না। এসব লেকে বাইরের যে উৎস থেকে পানি আসছে তা সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন স্থান থেকে সেখানে ময়লা আসছে।

ক্রিসেন্ট লেক : দীর্ঘদিন ধরে অযত্ন ও আর অবহেলার কারণে সৌন্দর্য হারাতে বসেছে রাজধানীর জিয়া উদ্যানের পাশের ক্রিসেন্ট লেকটিও। গণভবন-সংলগ্ন লেকটির একপাশে শ্যাওলা ও ময়লা-আবর্জনার স্তূূপ জমে আছে। লেকের ব্রিজের পাশে সাধারণ মানুষের গোসল করা আর কাপড় ধোয়ার কারণে পানি ঘোলা হয়ে গেছে। এ ছাড়া ক্রিসেট লেক সংলগ্ন পার্কে আসা মানুষও খাবারের প্যাকেট ও বর্জ্য লেকের পানিতে ফেলে লেক দূষণ করছেন।

সর্বশেষ খবর