বুধবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মাদকের অদৃশ্য হাট

মির্জা মেহেদী তমাল

মাদকের অদৃশ্য হাট

দেশের একজন টাইলস ব্যবসায়ী রবি। বাংলামোটরে তার দোকান রয়েছে। সেই দোকানের নামে তিনি ফেসবুক পেইজ ও গ্রুপ করেছিলেন। তার স্ত্রী, শ্যালিকাসহ ঘনিষ্ঠরা গ্রুপে ভীষণ সক্রিয়। গ্রুপে চ্যাট করতেন। প্রয়োজনীয় কথা বলতে কল করতেন ভাইবার, ইমো ও হোয়াটসঅ্যাপে। তবে তাদের এই পেজের আড়ালে ছিল ভয়ঙ্কর বাণিজ্য। মরণনেশা ইয়াবা পাইকারি  বেচাকেনার পেজ হয়ে ওঠে সেটি। বিশ্বস্ত, পরিচিত বিক্রেতারা গ্রুপে চ্যাট করে অর্ডার দিতেন। ভাষা ছিল সাঙ্কেতিক। অর্ডার নিয়ে যথাস্থানে তা পৌঁছে দেওয়া হতো। এমনকি নিরাপদে টাইলসের শোরুম থেকেও ইয়াবা সংগ্রহ করতেন মাদকাসক্তরা। বিষয়টি নজরে পড়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের। এর কিছুদিন পরই এলিফ্যান্ট রোডের শেল সিদ্দিক বহুতল ভবনে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় টাইলস ব্যবসায়ী ও তার স্ত্রীকে। পরে ধানমন্ডি থেকে শ্যালিকা, ভায়রাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর পশ্চিম রাজাবাজার থেকে গ্রেফতার করা হয় ব্যবসায়ীর শাশুড়িকে। সেখান থেকে উদ্ধার হয় ৫০ হাজার পিস ইয়াবা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের জেরার মুখে তারা স্বীকার করেছে, এমন বেশ কিছু ব্যবসায়ী রয়েছে যারা অনলাইনে মাদক ব্যবসা করছে চুটিয়ে। এমন কজন ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করতেও সমর্থ হয় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা।

নিত্য ব্যবহারের জিনিসপত্র থেকে শুরু করে গবাদিপশু, গাড়ি, বাড়ি সবই কেনা যাচ্ছে এখন অনলাইনে। অনলাইন শপিংয়ের এই সময়ে বাদ যাচ্ছে না মাদকও। অনলাইনে অর্ডার দিলে অন্যান্য পণ্যের মতোই বাসায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে মাদক। হোম  ডেলিভারির এই সুযোগ লুফে নিচ্ছেন এক শ্রেণির মাদকসেবীরা। এ সুযোগ নিচ্ছেন অনেক নারীও। মাদকসেবী ও বিক্রেতাদের অসংখ্য গ্রুপ রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। এ ছাড়াও তারা ভাইবার, ইমো ব্যবহার করে থাকে। নিরাপত্তার জন্য সাংকেতিক ভাষায় কথা বলে এরা। পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কাছেও এমন সব তথ্য। তাদের চোখ এখন মাদক বিক্রির এ অদৃশ্য হাটে। তারা বলছে, অনলাইনে মাদক  বেচাকেনায় নজরদারি ও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে অভিযানও শুরু হয়েছে। জানা গেছে, সম্প্রতি মাদকবিরোধী অভিযান চলার পর বেশ কিছু মাদক সাম্রাজ্য তছনছ হয়। এমন একটি বড় আখড়া  মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প। আগের মতো প্রকাশ্যে মাদক বিক্রির কোনো চিত্র সেখানে দেখা যায় না। ক্যাম্পে খুচরা মাদক ব্যবসায়ীদের বিচরণ লক্ষ্য করা গেলেও অপরিচিত কারও কাছে তারা মাদক বিক্রি করে কম। ক্যাম্পের এক মাদকাসক্ত যুবক জানান, ক্যাম্পে এখনও মাদক বিক্রি হয়। শুধু পরিচিতদের কাছে তা বিক্রি করা হয়। সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ইমোর মাধ্যমে ম্যাসেজ দিলে ব্যবসায়ীরা অন্যত্র মাদক (গাঁজা)  পৌঁছে দেন। ক্যাম্পের ভিতর ইয়াবা কিংবা অন্য কোনো মাদক বিক্রি হয় না। সেখানকার কয়েকজন মাদক সেবনকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে অনলাইনে বিশেষ করে ফেসবুক  পেজের মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা, গাঁজার মতো মাদক। আগে বিয়ার ও মদের জন্য অনলাইন মাধ্যম খুব জনপ্রিয় হলেও বর্তমানে সব মাদকই মিলছে অনলাইনে। সম্প্রতি এ ধরনের পাঁচটি পেজ শনাক্ত করেছে পুলিশের সাইবার ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিট। তদন্তের মাধ্যমে তারা জানতে পেরেছেন, পালিয়ে  বেড়ানো রাঘববোয়ালরাই এসব অনলাইন পেজ পরিচালনা করছেন এবং এসব পেজের মাধ্যমে মাদক কেনাবেচা হচ্ছে। অনলাইনে মাদক ব্যবসা ও মনিটরিংয়ের বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘আমরা অনলাইনে মাদক ব্যবসার কথা শুনেছি। কিছু কেস পেয়েছি, তবে এ ধরনের অপরাধীকে ধরতে প্রযুক্তিগত দিক থেকে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমাদের কর্মকর্তাদের ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে অনলাইনে মনিটরিং এবং শনাক্ত করার জন্য। তবে সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য পেলে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব। এ বিষয়ে পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম (সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং) বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ধরনের ৪-৫টি পেজ শনাক্ত করা হয়েছে। অনলাইনে পুলিশের নজরদারি  টের পেয়ে ইতিমধ্যে কয়েকটি পেজ তাদের মাদক বিক্রির কনটেন্টগুলো সরিয়ে ফেলেছে। তবুও যেটুকু (কনটেন্ট) পেয়েছি  সেগুলো অভিযানের স্বার্থে প্রকাশ করা হচ্ছে না। আমরা অভিযানের জন্য ইন্টেলিজেন্স ও ইনফরমেশন গ্যাদার করছি। অফলাইন ও অনলাইনের মাদক বিক্রেতাদের গডফাদাররা একই’। তিনি বলেন, ‘ইন্টারনেট ছাড়া ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমেও মাদকের কেনাবেচা হচ্ছে। ডার্ক ওয়েবে মাদক বিক্রি খুবই অ্যালার্মিং একটি বিষয়। এখানে হেরোইন,  কোকেন ও আফিমের মতো মাদক বিক্রি হয়।’ ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এখানকার বিক্রেতাদের শনাক্ত করা একটু জটিল। কারণ ডার্ক ওয়েবের কনটেন্ট ট্র্যাক করে মাদক বিক্রেতা পর্যন্ত পৌঁছানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তবে শিগগিরই আমরা ডার্ক ওয়েব কন্ট্রোল করতে পারব বলে আশা করছি। যদি এটি আমাদের কন্ট্রোলে আসে, তাহলে মাদকের বড় চালানের তথ্যবর করে গডফাদারদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর