শুক্রবার, ২ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বন্ধু নয় ঘাতক

মির্জা মেহেদী তমাল

বন্ধু নয় ঘাতক

সৈকত নন্দী ও প্রতীক মজুমদার। নবম শ্রেণির ছাত্র। ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এক স্কুলে পড়ে। স্কুলেও তারা পাশাপাশি বসে। চলাফেরা, খেলাধুলা— সবকিছুই তাদের একসঙ্গে। তাদের এই বন্ধুত্বের কারণে অনেকেই মানিক-জোড় বলতেন। এক সকালে সৈকত নন্দীর বাবা সজল নন্দী খুন হন। নিজ বাসার বেডরুমে। অজ্ঞাত খুনির দল বাসায় ঢুকে সজল নন্দীকে গলা কেটে হত্যা করে পালিয়েছে। তার আগে বাসা তছনছ করেছে। চাবি দিয়ে টাকা-পয়সা হাতড়ে নিয়েছে। প্রিয় বাবাকে হারিয়ে সৈকত নন্দী পাগলপ্রায়। এ সময় প্রিয় বন্ধু প্রতীক তাকে সান্ত্বনা দেয়। পুলিশ খুনির দলকে শনাক্ত করতে মাঠে নামে। ক্লু লেস এই মার্ডারের তদন্তে পুলিশ সুরাহা করতে হিমশিম খায়।

ঘটনাটি চট্টগ্রামের হালিশহরের। রূপালী ব্যাংক কর্মকর্তা সজল নন্দীর তদন্তে অগ্রগতি নেই। এক পর্যায়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত শুরু করে। তদন্তে যা বেরিয়ে আসে, তা জানতে কেউ প্রস্তুত ছিল না। পুলিশ এই খুনের ঘটনায় গ্রেফতার করে নিহত ব্যাংক কর্মকর্তা সজল নন্দীর কিশোর বয়সী ছেলে সৈকতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রতীককে। আরও গ্রেফতার হয় প্রতীকের অপর দুই বন্ধু জিকু রায় চৌধুরী এবং জয় বড়ুয়া চৌধুরীকে। এদের প্রত্যেকের বয়স ১৭ থেকে ১৮। সজল নন্দীর ছেলে সৈকত তার বন্ধু প্রতীককে গ্রেফতারের পর নিজেই হতবাক। প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি সে। ভেবেছিল এটি পুলিশের ভুল। সে নিজেও পুলিশকে তা বলেছিল। কিন্তু পুলিশের তদন্তে যা বেরিয়েছে তাই তো পুলিশ গ্রহণ করবে। সৈকতের কথায় পাত্তা না দিয়ে পুলিশ প্রতীকসহ তিনজনকে জেরা করতে থাকে। তারা আস্তে আস্তে পুরো ঘটনার বিষয় স্বীকার করে। পুলিশ জানায়, নিহত ব্যাংক কর্মকর্তা সজল নন্দীর ছেলে সৈকত নন্দী এবং প্রতীক মজুমদার একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে। সে সুবাদে তারা পরস্পর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সম্প্রতি সজল নন্দী গৃহনির্মাণ বাবদ ব্যাংক থেকে ২৯ লাখ টাকা ঋণ পান। সৈকত এক দিন কথাচ্ছলে বিষয়টি ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রতীককে জানায়। সৈকতের কাছ থেকে টাকার বিষয়টি জানার পরই তার টাকা লুটের বিষয়টি মাথায় ঢুকে। সেই টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা আঁটে প্রতীক। প্রথমে সে বিষয়টি তার অপর দুই বন্ধু জয় ও জিকুকে জানায়। তারপর তিনজন মিলে সেই ২৯ লাখ টাকা লুটের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা নতুন ছুরিও কেনে। ঘটনার দিন ২৭ মে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে প্রতীক, জয় ও জিকু ওই বাসায় যায়। ওরা জানত এ সময় বাসায় নেই তাদের বন্ধু সৈকত। সৈকতের মা চলে যাবেন নিজের কর্মস্থলে। তিনজন মিলে সৈকতের বাসায় যায়। দরজা খুলে দেন সৈকতের বাবা সজল নন্দী। প্রতীক বলে, কাকা সৈকতের সাইকেল কিনবে তারা। এ কথা শুনে সজল নন্দী তাদের ভিতরে ঢুকতে দেন। বাসায় প্রবেশের পরপরই পরিকল্পিতভাবে সাইকেলের বিষয় নিয়ে নৈকতের বাবার সঙ্গে কথা কাটাকাটি শুরু করে প্রতীক। তখন জিকু সৈকতের বাবা সজল নন্দীর মাথায় তালা দিয়ে আঘাত করে। সজল চিৎকার দিলে প্রতীক তার মুখ চেপে ধরে। জিকু ও জয় মিলে গামছা দিয়ে সজলের পা বেঁধে ফেলে। এরপর জয় ছোরা দিয়ে সজল নন্দীর গলা কেটে হত্যা করে। এরপর তিনজন মিলে সজলের পকেট থেকে চাবি বের করে আলমারি খুলে ২৯ লাখ টাকা খোঁজ করে। টাকা না পেয়ে তারা ছোরা ও চাবি নিয়ে চলে যায়। পরে ব্যবহৃত ছোরা এবং ব্যাংকের চাবি পুকুরে ফেলে দেয় হত্যাকারীরা। পুকুরে তল্লাশি করে ছোরাটি উদ্ধার করেছে পুলিশ। সংশ্লিষ্টরা বলছে, প্রতীক কখনই বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি। বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে সে হয়ে উঠেছিল একটি ঘাতক। এই ঘাতকই সৈকতের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। যার কাছে নৃশংসভাবে খুন হয়েছে তার বাবা ব্যাংক কর্মকর্তা সজল নন্দী। তারা বলেন, বন্ধু কাকে করা যাবে, কে বিশ্বস্ত বন্ধু তা নির্বাচন করতে হবে। অভিভাবকদেরও আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কিশোর বয়সী সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে এটি খোঁজ রাখা বাবা-মায়ের দায়িত্ব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর