শিরোনাম
শনিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

জিঘাংসায় সব শেষ

মির্জা মেহেদী তমাল

জিঘাংসায় সব শেষ

খুলনার মানিকতলার জাহাঙ্গীর হোসেন খানের মেয়ে সোনিয়ার সঙ্গে হাফিজুর রহমানের বিয়ে হয়। এর ছয় মাস পর হাফিজুর রহমান বিদেশে চলে যান। স্বামীর অনুপস্থিতিতে সোনিয়ার চলাফেরা উচ্ছৃঙ্খল হতে থাকে। তিনি স্থানীয় এক যুবকের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। দেশে আসার পর বিষয়টি জানতে পারেন স্বামী হাফিজুর রহমান। লোকমুখে ঘটনা শুনে স্ত্রীকে শোধরানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত তালাক দেন স্ত্রীকে। তাদের ৯ বছরের একমাত্র শিশু সন্তান হাসমিকে রেখে দেন বাবা। তালাক দেওয়া ও সন্তানকে রেখে দেওয়ায় ভীষণ ক্ষুব্ধ থাকেন সোনিয়া। তিনি তার সাবেক স্বামী হাফিজুরকে চরম শিক্ষা দিতে চান। কিন্তু কীভাবে দিবেন, তা মাথায় ঢুকে না। তার পরিচিত লোকজনের কাছে এ নিয়ে বুদ্ধি পরামর্শ চান। অনেকে অনেক ধরনের বুদ্ধি দেয়। তার পছন্দ হয় ছেলেকে নিয়ে আসার। সোনিয়া জানেন, হাফিজুরের দুর্বলতা তাদের সন্তান। সন্তানকে তার কাছ থেকে দূরে সরালেই চরম শিক্ষা দেওয়া হবে। হাফিজুরের কাছ থেকে সন্তানকে নিয়ে আসার পরিকল্পনা আঁটতে থাকেন সোনিয়া। সেটা যেকোনো উপায়ে হোক। হাসমিকে অপহরণ করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে সোনিয়া। এর জন্য তার পরিচিত দুই যুবক নুরুন্নবী ও রসুলের সঙ্গে ৫০০ টাকায় চুক্তি করেন সোনিয়া। কিন্তু দুই যুবকের আরও দাবি আছে। তাদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক করতে হবে। সোনিয়া তাতেও রাজি হয়ে যান। ২০১৬ সালে খুলনার ঘটনা এটি। পরিকল্পনা মতে, এক রাতে সেই দুই যুবক হাফিজুরের বাড়ির সামনে যেয়ে ওতপেতে থাকে। সোনিয়ার কাছ থেকে তারা জেনে নিয়েছে, রাতের এক সময় হাসমি টয়লেটে যায়। সেই সময়েই তাকে তুলে আনতে হবে। ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোন। উঠোনের এক কোণে টয়লেট। দুই যুবককে বেশিক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হয়নি। পৌনে নয়টার দিকেই হাসমি বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। সুযোগ তারা পেয়ে যায়। হাসমির মুখ চেপে ধরেই দুই যুবক বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে। গ্রামের অন্ধকার মোঠো পথ ধরে হাসমিকে তার মায়ের কাছে আনতে বেগ পেতে হয়নি। আগে থেকে সরদারডাঙ্গা বাগানের (বাঁশঝাড়) আড়ালে অপেক্ষায় ছিলেন সোনিয়া। হাসমিকে দেখে সোনিয়া যতটুকু না খুশি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছে হাফিজুর একা হয়ে যাওয়ায়। চুক্তি অনুযায়ী সেই দুই যুবককে ৫শ টাকা দেয় সোনিয়া। এরপর হাসমিকে তারা বাঁশঝাড়ের এক স্থানে বসিয়ে রাখে। সোনিয়া দুই যুবককে নিয়ে অন্ধকার স্থানে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। হাসমি হেঁটে হেঁটে তার মায়ের কাছাকাছি চলে আসে। সামনা সামনি এসেই তার মাকে দেখতে পান দুই যুবকের সঙ্গে। তারা হাসমিকে খেয়াল করেনি। হাসমি তখন বলে ‘মা’ তুমি কী করতেছো, আমি বাবাকে সব বলে দেব’। মা তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে বলে, এই চুপ কর। তাদের অনৈতিক সম্পর্কের ঘটনা বাইরে ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয় পান তিনজনই। মা সোনিয়ার সামনেই শিশু হাসমিকে মুখ চেপে ধরে দুই যুবক। হাসমি তখন বলছিল, মা আমাকে বাঁচাও। কিন্তু সোনিয়া ছিল নির্লিপ্ত। যুবকরা তাদের কাছে থাকা ছুরি চালিয়ে দেয় হাসমির গলায়। হাসমির মৃত্যু ঘটে সেখানেই। হত্যার পর লাশ গুমের জন্য ওই রাতেই সিমেন্টের বস্তায় ভরে খুলনা বাইপাস সড়ক-সংলগ্ন সরদারডাঙ্গা বিলের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। এ ঘটনার তিন দিন পর সকালে খুলনা বাইপাস সড়ক-সংলগ্ন সরদারডাঙ্গা বিলের মধ্যে থেকে সিমেন্টের বস্তাবন্দী অবস্থায় হাসমির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় সেদিনই হাসমির বাবা হাফিজুর রহমান বাদী হয়ে নুরুন্নবী, হাফিজ, মো. রসুলের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ২/৩ জনের বিরুদ্ধে অপহরণের পর হত্যা ও লাশ গুমের মামলা দায়ের করেন (নং-০২)। তদন্ত কর্মকর্তা আড়ংঘাটা থানার এসআই মো. মিজানুর রহমান এজাহারভুক্ত হাফিজ ও আসাদ ফকিরকে বাদ দিয়ে সোনিয়া আক্তার নুরুন্নবী ও রসুলের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। ওই চার্জশিটের বিরুদ্ধে বাদীর নারাজি আবেদনের পর পুনরায় তদন্ত শেষে সিআইডির পরিদর্শক মিঠু রানী দাসি সাতজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। খুলনা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে চার্জশিট গৃহীত হওয়ার পর মামলাটি বিচারের জন্য মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে এ মামলার চার্জশিটভুক্ত দুজন আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে পাঁচজনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। অভিযোগ গঠন হওয়া পাঁচ আসামি হলেন— সোনিয়া আক্তার, মো. নুরুন্নবী, মো. রসুল, মো. হাফিজুর রহমান ও রাব্বি সরদার। এ ছাড়া অব্যাহতি পাওয়া দুজন হলেন মো. জসিম খান ও মো. আসাদ ফকির।

মামলার বিচারে হাসমির মাসহ চারজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় আদালত। এরা হলেন— শিশু হাসমির মা সোনিয়া আক্তার, নুরুন্নবী, রসুল এবং হাফিজ। 

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছিল সোনিয়া। প্রতিশোধ নিতে যেয়ে নিজের সন্তানকে হত্যা করল। এখন চার দেয়াল তার ঠিকানা। আদালত তার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দিয়েছে। জিঘাংসায় সব শেষ হয়। তার প্রমাণ হাসমি হত্যার ঘটনাটি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর