রবিবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

২৭ বছর ঝুলে আছে পাকিস্তানি জাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত

দুর্নীতির অভিযোগে চুক্তি বাতিল করে সাহাবুদ্দীন সরকার, সমঝোতা করে জাহাজের পরিবর্তে অন্য পণ্য আনতে চেয়েছিল বিএনপি সরকার

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

পাকিস্তান থেকে দুটি কনটেইনার জাহাজ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ১৯৮৮ সালে দেশটির সঙ্গে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি করেছিল তখনকার সরকার। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় ১৯৯১ সালে ওই চুক্তিটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেই সময়ে ক্ষমতাসীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সরকার। তবে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন সরকারের চুক্তি বাতিলের সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর না করে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতা করে জাহাজের পরিবর্তে অন্য কোনো পণ্যসামগ্রী কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই থেকে এখনো ঝুলে আছে পাকিস্তানের কাছ থেকে জাহাজ কেনার চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত। সূত্রগুলো জানায়, চুক্তিটি বাস্তবায়ন হয়নি। ঋণপত্রের মেয়াদও শেষ হয়েছে অনেক আগে। পাকিস্তানের কাছে চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে তথ্য চাইলেও তারা কোনো কিছু জানায়নি। এ অবস্থায় এখনো প্রতি মাসে সেই চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদন জানাতে হচ্ছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে।

সূত্রগুলো আরও জানায়, দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে এ ধরনের অগ্রগতি প্রতিবেদন দিয়ে যাওয়ার পর সম্প্রতি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পাকিস্তানি জাহাজ কেনার অগ্রগতি প্রতিবেদন মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন তালিকা থেকে বাতিলের অনুরোধ জানাবে। একই সঙ্গে চুক্তিটি বাতিলের বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগেও চিঠি পাঠাবে। জানতে চাইলে নৌপরিবহন সচিব মো. আবদুস সামাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন আগে করা এই চুক্তির বিষয়ে তথ্য চেয়ে আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করেছি। জেইসি বৈঠকেও বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে তারা এ বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়নি আমাদের। এখন আমরা চুক্তি বাতিলের বিষয়ে ইআরডিকে চিঠি দেব।’ সূত্র জানায়, ২৩ অক্টোবর বিষয়টি নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবদুস সামাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জাহাজ পরিচালনা করে। জাহাজ ছাড়া অন্য কোনো পণ্যসামগ্রী বিএসসির প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া বাংলাদেশ-পাকিস্তান ষষ্ঠ জেইসি সভায় বিষয়টি আলোচনা হলেও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে অদ্যাবধি কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। তাই জাহাজ কেনার ইস্যুটি মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার অনুরোধ জানানো যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে ৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তির পর পরবর্তী সময়ে ওই ঋণের ৪৪ দশমিক ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে দুটি কনটেইনার জাহাজ কেনার জন্য বিএসসি ও করাচি শিপইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মধ্যে ১৯৯০ সালে একটি কারিগরি চুক্তি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোনীত জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে করাচি শিপইয়ার্ডের অনুকূলে দুটি ঋণপত্র খোলা হয়। ওই সময় জাহাজ কেনার বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। পরে ১৯৯১ সালের ২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় চুক্তিটি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৯৩ সালে ঋণপত্র দুটির চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। পরে একই বছর ১৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত তখনকার বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সভায় সিদ্ধান্ত হয় চুক্তিটি একতরফাভাবে বাতিলের পরিবর্তে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে জাহাজের পরিবর্তে সমপরিমাণ অর্থে অন্য কোনো সামগ্রী কেনার। তবে জাহাজ কেনার পরিবর্তে ওই ঋণে অন্য কোনো সামগ্রী আমদানির প্রয়োজন নেই বলে ১৯৯৫ সালে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) জানিয়ে দেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। ২০০৮ সালের ২১ এপ্রিল এক চিঠিতে ইআরডি জানায়, বাংলাদেশ-পাকিস্তান জেইসি ষষ্ঠ সভায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিষয়টি উত্থাপিত হলেও পাকিস্তান জানায়, চুক্তির বিষয় পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য তারা একটি কমিশন করেছে। তবে এরপর এ বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো তথ্য বাংলাদেশকে দেয়নি পাকিস্তান। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় জানায়, পাকিস্তানের সঙ্গে এরপর আরও দুটি জেইসি (সপ্তম ও অষ্টম) অনুষ্ঠিত হলেও জাহাজ ক্রয়-সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়নি পাকিস্তান। নবম জেইসি সভায় ইস্যুটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ইআরডিকে অনুরোধ জানানোর পর ইআরডি জানায়, পাকিস্তান ওই সভাটি স্থগিত করেছে। সূত্রগুলো জানায়, পাকিস্তান থেকে কোনো ধরনের তথ্য না পাওয়ায় ২০১০ সালের ১০ মে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সভায় ‘১৯৯৩ সালের মন্ত্রিপরিষদ সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত (পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে দেশটি থেকে জাহাজের পরিবর্তে অন্য সামগ্রী কেনা)’ বাতিলের জন্য একটি সারসংক্ষেপ পাঠায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রিসভা উদ্যোক্তা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে বিষয়টি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ২০১১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে আবারও নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পর থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি না থাকলেও ঝুলে থাকা একটি ইস্যু সম্পর্কে অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে হচ্ছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর