সোমবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

কন্যাসন্তানের মায়েদের ক্ষমতা উপার্জন দুই-ই বেশি

ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদন

জিন্নাতুন নূর

নাসির আলী-রিনা আক্তার দম্পতির বিয়ে হয় ১৯৮৮ সালে। বিয়ের এক বছরের মাথায় তাদের ঘরে আসে কন্যা, পারমিতা প্রজ্ঞা। এরপর এ দম্পতির আর কোনো সন্তান হয়নি। মেয়ের প্রতি রিনার যত্নের কোনো কমতি না থাকলেও মেয়ে বলে প্রজ্ঞার ভরণপোষণে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে চাইতেন না নাসির। প্রজ্ঞার জন্য বাড়তি হাতখরচের টাকা চাইলে উল্টো রিনাকে কথা শুনতে হতো। কিন্তু থেমে যাননি রিনা। বেশি পড়ালেখা না করলেও নিজেই সেলাই করে, ব্লক-বুটিকের কাজ শিখে মেয়ের সব আবদার পূরণ করেছেন। প্রজ্ঞাকে নাচ, গান, ছবি আঁকা থেকে শুরু করে কোচিং ক্লাসে পাঠানো সবই নিজ দায়িত্বে করেছেন। প্রজ্ঞা এখন অস্ট্রেলিয়ায় কাজ করছে। সম্প্রতি তার মাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে গিয়ে ঘুরিয়েছে এক মাস। এই মা-মেয়ে দুজনই একে অন্যকে নিয়ে গর্বিত।

কচি আক্তার-সুমন রহমান দম্পতির বিয়ে হয় ১৯৯৯ সালে। বিয়ের পর কচিকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আর লেখাপড়া করতে দেননি। বিয়ের দুই বছরের মাথায় জয় নামে পুত্রসন্তানের মা হন কচি। এর পরের বছর আইরিন নামে এক কন্যাসন্তান জন্ম দেন। জয়ের জন্য তার বাবা প্রায়ই অফিস থেকে ফেরার পথে খেলনা, নতুন জামা আনলেও আইরিনের জন্য কালেভাদ্রে কিছু নিয়ে আসতেন। মেয়ের মন খারাপ যাতে না হয় এজন্য নিজের জমানো টাকা থেকে মেয়ের জন্য খেলনা-জামা কিনতেন কচি। ছেলেকে  কোচিংয়ের পাশাপাশি ক্রিকেট কোচিংয়ে ভর্তি করে দিলেও মেয়ে কারাতে ক্লাসে ভর্তি হতে চাইলে ঝাড়ি দেন সুমন। এর আগে ভায়োলিন ক্লাসেও যেতে বারণ করেন মেয়েকে। মেয়ের মন খারাপ দেখে শেষমেশ অনেকটা বাধ্য হয়ে ঘরে খাবারের আইটেম বানিয়ে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেন কচি। এখন নিজের শখ-আহ্লাদ পূরণ করতে আইরিনকে আর বাবার কাছে হাত পাততে হয় না। সংসারের সচ্ছলতা আনার পাশাপাশি দুই ছেলেমেয়ের হাতখরচও বহন করছেন কচি। এতে পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার গুরুত্ব আগের চেয়ে বেড়েছে। সামাজিক ও পারিবারিক রীতিনীতির কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় সন্তান জন্মদানের সময় নারীরা আশায় থাকেন একটি পুত্রসন্তান জন্ম নেবে। কিন্তু পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও কন্যাসন্তানই একজন নারীকে তার সংসারের স্বায়ত্তশাসন ও পারিবারিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সহায়তা করে। সম্প্রতি গবেষণাধর্মী ওয়েবসাইট সায়েন্স ডাইরেক্টে প্রকাশিত ‘ওরথ ফাইটিনিং ফর : ডটারস ইমপ্রুভ দেয়ার মাদারস অটোনমি ইন সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক গবেষণায় এমনটি জানানো হয়। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির সম্প্রতি প্রকাশিত এই গবেষণা প্রতিবেদনে গবেষক র্যাচেল হিথ ও জু ট্যান এসব তথ্য উদ্ঘাটন করেন। গবেষণাটি সম্পন্ন করতে গবেষকরা সে সময়ের হালনাগাদ তথ্য, যেমন ভারতের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে (২০০৫-০৬) এবং ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ফর বাংলাদেশের (২০০৭-২০১১) তথ্য ব্যবহার করেন। এতে গবেষকরা দেখতে পান, পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং গতিশীলতার জন্য পুত্রসন্তানের চেয়ে কন্যাসন্তানরা নারীদের জন্য বেশি সহায়ক। গবেষণার ফলাফলটির সঙ্গে একমত পোষণ করে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘এ কথা সত্য যে আমাদের দেশের মায়েরা মেয়ের প্রতিপালনের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হলে নিজে আয়-উপার্জন করে হলেও মেয়েকে বড় করে তোলেন। আবার মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেলে মা ও পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে সংসারে নারীদের স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। যদিও এখনো সমাজে এ ব্যাপারে নারীরা কিছুটা বাধার মুখোমুখি হচ্ছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সমাজের মানুষদের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনতে হবে।’

গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, একটি কন্যাসন্তানের মা তার মেয়ের ভরণপোষণের ক্ষেত্রে বাবার চেয়ে বেশি আন্তরিক। আর কন্যাসন্তানের প্রতি এ আন্তরিকতা নারীকে বাড়ির আয়ের ওপর বেশি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে এবং ঘরের বাইরে আয়-উপার্জনে সম্পৃক্ত করে। আর এ উপার্জনের অর্থ নারীরা তাদের কন্যাসন্তানের ভরণপোষণের পেছনে ব্যয় করেন। বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য দুই গবেষক গবেষণায় তালিকাভুক্ত পরিবারগুলোর মধ্যে মহিলাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে তাদের দেওয়া প্রতিক্রিয়ার একটি ছক তৈরি করেন। আর সেখানে ভারত-বাংলাদেশ উভয় দেশের ক্ষেত্রেই পুত্রসন্তানের মায়ের চেয়ে একজন কন্যাসন্তানের মায়ের পরিবারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যে বেশি থাকে তা প্রমাণিত হয়। এমনকি কন্যাসন্তানের মায়েরা গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি আয়-উপার্জনেও অধিক হারে সম্পৃক্ত। গবেষণায় দেখা যায়, দুই দেশেই যেসব নারী কন্যাসন্তান জন্ম দিয়েছেন, তারা পুত্রসন্তানের মায়েদের চেয়ে ঘরের বাইরে কাজ করছেন বেশি। বিশেষ করে এ ধরনের মায়েদের উচ্চ মজুরিতে কাজ করার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। আর এই মায়েরা যদি বুঝতে পারেন যে কন্যার ভরণপোষণের জন্য তার স্বামী খরচ কম করবেন, তাহলে তিনি নিজ খরচের পরিমাণ কমিয়ে হলেও সেই অর্থ কন্যার পেছনে ব্যয় করেন। যদিও এ ধরনের নারীদের সামাজিক রীতিনীতি এবং পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে আয়-উপার্জনে সম্পৃক্ত হতে হচ্ছে। এজন্য তাদের কটুকথাও শুনতে হচ্ছে এবং অনেকে পারিবারিক কলহের শিকার হচ্ছেন। আর এ কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীই সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে কন্যাসন্তানের চেয়ে পুত্রসন্তানের প্রতি আগ্রহী হন।

সর্বশেষ খবর