বুধবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

আবার ‘গ্যাংস্টার’ আতঙ্ক

সাখাওয়াত কাওসার

আবার ‘গ্যাংস্টার’ আতঙ্ক

শুরুতে স্রেফ বাইক স্ট্যান্টিংয়ের মধ্যে বিনোদন খুঁজে ওরা। কিছুদিন যাওয়ার পর ওরা মোটরবাইকের অরিজিনাল সাইলেন্সর (ধোঁয়া নির্গমনের যন্ত্রাংশ) পরিবর্তন করে ফেলছে। সেখানে লাগাচ্ছে পাইপ কেটে তৈরি করা বিকট শব্দের বিশেষ ধরনের সাইলেন্সর। এর কিছুদিন পর ৮-১০ জন যুবক মিলে তৈরি করছে গ্যাং। ভাগ করে নিচ্ছে নিজেদের এলাকা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এবং এলাকার দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দিচ্ছে নিজেদের গ্যাংয়ের নাম। তবে উদ্বেগের কারণ হলো, সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে সক্রিয় অর্ধশতাধিক গ্যাংস্টার গ্রুপের সদস্যরা জড়িয়ে যাচ্ছে চাঁদাবাজি, মাদক সেবন-ব্যবসা, ইভ টিজিংয়ের মতো ভয়ঙ্কর সব অপরাধ কর্মকাণ্ডে। টার্গেট পূরণের জন্য অস্ত্রের ব্যবহার করতেও দ্বিধা করছে না ওরা। দল ভারী এবং শক্তি বৃদ্ধির জন্য এসব ধনীর দুলালেরা নিজেদের গ্রুপে ভেড়াচ্ছে বস্তির টোকাই থেকে শুরু করে মহল্লার বখাটেদের। অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, হাতে বাড়তি টাকা, মাদকের সহজ প্রাপ্তি, চাইতে না চাইতেই তরুণ-তরুণীদের চাহিদা পূরণ তাদের বখে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। টেকনোলজি ব্যবহার করলেও উঠতি বয়সের অনেকেই বুঝতে পারছে না সেটা দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে কতটুকু গ্রহণ করা উচিত। একই সঙ্গে খেলাধুলা এবং পর্যাপ্ত নির্মল বিনোদনের অভাবও তরুণদের বখে যাওয়ার জন্য অনেকটাই দায়ী। তাদের আশঙ্কা, দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এরা জঙ্গি সন্ত্রাসের চেয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। বিদ্যমান ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম দিয়ে এটা রোধ করা যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন সামাজিক প্রতিরোধ।

গত শনিবার রাত ৮টার দিকে চাঁদা না দেওয়ায় ক্রাস বিডি গ্যাংস্টার গ্রুপের সদস্যরা খিলগাঁও তালতলা মেম্বার গলিতে গুলির ঘটনা ঘটিয়েছে। ২৭৫/বি নম্বর দোকানের মালিক মনির হোসেন নামে এক ব্যবসায়ীকে ছুরিকাঘাত করে এবং গুলি করে ছিনিয়ে নিয়েছে তার ক্যাশে থাকা ৫০ হাজার টাকা। খবর শুনে র‌্যাব-৩ মেজর গালিব মোহম্মদ নাতিকুর রহমানের  নেতৃত্বে একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনটি গুলির খোসা, একটি ডামি পিস্তলসহ তিনটি মোটরবাইক জব্দ করে। পরে ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে বাইকার গ্যাংস্টার গ্রুপের মেহেদী হাসান (২২), শাহরিয়ার (২২), কাজী ইউসুফ বিন শওকাত ওরফে অনিক (১৯), আমিনুল ইসলাম আমিন (২০), আবু হুরায়রা আদিব (১৮), সাব্বির হোসেন (১৮), শিশির আহম্মেদ ওরফে সজল (২২), মাজহারুল ইসলাম ওরফে অনিক ইসলাম (২১)-কে গ্রেফতার করে। জানা গেছে, স্থানীয় রাব্বি ওরফে পাঠা রাব্বি ও অদিতের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই গ্যাংস্টার গ্রুপ প্রথমে রোড রাইডার্স নামে ছিল। পরে ‘ক্রাস বিডি’ নামে এলাকায় প্রায় এক বছর ধরে ত্রাস সৃষ্টি করে আসছে। বাইক স্ট্যান্টের নাম করে দলে সদস্য জোগাড় করে এবং পরে ৩০-৪০ জনের বিশাল বাহিনী নিয়ে শোডাউন এর নাম করে চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। এই গ্রুপটি পুরান ঢাকার ‘বার্ন রাইডারস’ গ্রুপের সঙ্গে মোটরসাইকেল শোডাউন করে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করে। খিলগাঁও, সবুজবাগ, শাহজাহানপুর ও পুরান ঢাকার খান রাসেল গ্রুপ, শাহজাহানপুরের ইমন গ্রুপ, গোড়ানের হাওয়াই গলির মুজিবুর রহমান রানা, গোড়ান ঝিলপাড়ের ছিনতাইকারী মেহেদী গ্রুপ এবং পুরান ঢাকার অন্তত চারটি গ্যাংস্টার গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এসব গ্রুপের সদস্যদের বয়স ১৭ থেকে ২৪ এর মধ্যে।

গত শনিবার বোনের ইভ টিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় রাজধানীর জুরাইনে তুহিনের নেতৃত্বাধীন একটি গ্যাংস্টারের সদস্যরা ছুরিকাঘাত করে নৃশংসভাবে খুন করে শেখ পাভেল ইসলামকে।

র‌্যাব-৩-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এমরানুল হাসান এ প্রতিবেদককে বলেন, আমার ব্যাটালিয়ন এলাকায় আরও কয়েকটি গ্যাংস্টার গ্রুপ রয়েছে বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, হিরোইজম ও থ্রিল থেকে এসব কিশোররা ছিনতাই, মাদক বাণিজ্য, মাদক বহন, মাদক সরবরাহকারী, মাস্তানি, দাদগিরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। আমরা এগুলো নিয়ে কাজ করছি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমরা প্রয়োজনীয় সবকিছুই করব।

গত বছরের ৬ জানুয়ারি রাজধানীর উত্তরায় স্কুলছাত্র আদনান খুন হওয়ার পর গ্যাংস্টার গ্রুপের বিষয়টি উঠে আসে। তারই সমবয়সী ছেলেরা তাকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। এর আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গ্যাংস্টার নিয়ে তথ্য থাকলেও তারা তাতে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। তবে বর্তমানে গ্যাংস্টার গ্রুপ নগরবাসীর কাছে বড় আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় থাকায় এসব গ্যাংস্টার গ্রুপের সদস্যরা অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিপদে পড়লে ‘বড়ভাই’ নামধারী গডফাদাররা শেল্টার  দেয়। এ কারণে অভিযোগ করলে উল্টো অনেককেই বেকায়দায় পড়তে হয়। ভয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ দেওয়ার সাহসও পান না সাধারণ মানুষ। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর উত্তরা, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, বৃহত্তর মিরপুর, পুরান ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় এসব গ্যাং সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছে। এসব বাহিনী তিন-চার ধাপে বিস্তৃত। নিচের ধাপে বখাটে টিনএজাররা গ্যাংস্টার গ্রুপের সদস্য হয়ে কাজ করে। এদের প্রতিটি গ্রুপে একজন দলনেতা থাকে। যে প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলে এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বেশি পারদর্শী তাকে গ্রুপের নেতৃত্ব দেওয়া হয়। উত্তরা এলাকায় অন্তত ১৫-২০টি গ্রুপ সক্রিয় আছে। এদের সদস্য সংখ্যা তিন থেকে চার হাজার। তবে এখানে ডিসকো ও নাইন স্টার গ্রুপের প্রাধান্য বেশি। এর বাইরে রয়েছে নাইন স্টার, পাওয়ার বয়েজ, ডিজে বয়েজ, জি স্টার, ফোর সিভি বয়েজ, সেভেন স্টার, কিং নাইন, দাদা বয়েজ, রেড লাইট, প্রাণ টিএমসি প্রভৃতি। তেজগাঁও এলাকায় ডেডলি রকার্স, কে-ইউ, এসকে ৩০, ইএস ১৩ এবং পিপিসহ বিভিন্ন নামে চলে তাদের অপরাধ কার্যক্রম। সংশ্লিষ্টরা বলছে, প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও তাদের উপস্থিতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। অতীতে হত্যার ঘোষণা দিয়ে তারা ফেসবুকে ভিডিও আপলোড করছিল। শক্তিমত্তা এবং সদস্য সংখ্যা বাড়াতে তারা পাড়া-মহল্লায় ফেসবুকে প্রচারণা চালাচ্ছে। চাপের মুখে অনেক ভালো সহপাঠী এদের গ্রুপে যোগ দিতে বাধ্য হয়। আধিপত্যের নিয়ন্ত্রণ নিতে দেয়ালে দেয়ালে গ্যাং গ্রুপের চিকা মেরে এলাকায় আধিপত্য নিশ্চিত করছে। র‌্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম এ প্রতিবেদককে বলেন, উত্তরা এলাকায় অনেক গ্রুপ ভেঙে আরও নতুন নতুন গ্রুপ তৈরি হয়েছে বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। অনেক গ্রুপে তরুণীরাও রয়েছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, পারিবারিক এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে অনেক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তরুণ-তরুণীরা। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির অভাবও তরুণ-তরুণীদের বিপথে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এর বাইরে হরর ফিল্ম, বিদেশি সংস্কৃতি ভয়াল বিস্তার অনেকাংশে দায়ী। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, গত বছর উত্তরা ও তেজগাঁওয়ে দুই কিশোর নিহত হওয়ার পর থেকে আমরা এ বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। শুধু গ্রুপ বা গ্যাং নয়, এসবের বাইরেও যদি কেউ ফৌজদারি অপরাধ করে থাকে তাকেই গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। গ্রুপগুলোকে নজরদারিতে রাখা হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর