রবিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

চাঙ্গা থাকবে ভোটের অর্থনীতি

দুই ঈদের পর সংসদ নির্বাচনই সবচেয়ে বড় উৎসব, এবারের নির্বাচনে প্রার্থীরা খরচ করবেন প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা

মানিক মুনতাসির

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণকে কেন্দ্র করে দেশে কর্মচাঞ্চল্য বাড়ছে; যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রভাবে আরও চাঙ্গা হয়ে উঠবে ভোটের অর্থনীতি। কেননা ঈদ-উৎসব, পূর্জা কিংবা জাতীয় নির্বাচনের সময় শহরের পাশাপাশি প্রত্যন্ত গ্রামেও নগদ অর্থের সরবরাহ বাড়ে। এ সময় গ্রামের ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা হয়। ভোগের উষ্ণতা চায়ের কাপের ঝড়কে প্রভাবিত করে। ফলে বিকিকিনি কয়েক গুণ বাড়ে। নির্বাচন কেন্দ্র করে প্রার্থীরা ভোটের মাঠে ছোটাছুটি করছেন। অর্থনীতির ভাষায় কর্মচাঞ্চল্য বাড়লে মানুষের ভোগ কিংবা ব্যয় বাড়ে; যা দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার সহায়ক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎসবমাত্রই অর্থনীতিতে এক ধরনের গতির সঞ্চার করে। নির্বাচনের সময় রাজধানীসহ সারা দেশের প্রার্থীরা ছোটাছুটি করেন। এবারও করছেন। এতে গ্রামাঞ্চলের অর্থনীতিতে এক ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে কোনোভাবেই যেন সহিংসতা না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সহিংসতায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে মনে করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। বিশেষজ্ঞদের মতে, দুটি ঈদের কথা বাদ দিলে ‘সংসদ নির্বাচনী উৎসব’ই সবচেয়ে বড় উৎসব, যদিও তা পাঁচ বছর পরপর আসে। গতবারের নির্বাচন খুব একটা জমেনি। কারণ অর্ধেকেরও বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিল না। ফলে টাকাও সেভাবে গ্রামাঞ্চলে যায়নি। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। এখন অবস্থাও বদলেছে। ঘরে ঘরে প্রার্থী। ব্যবসায়ী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী, রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, ডাক্তার-আইনজীবী, সাংবাদিক, ব্যারিস্টার, ব্যাংকার, অভিনেতা-অভিনেত্রী, শিল্পী সকল শ্রেণির মানুষই এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, শতাধিক ব্যবসায়ীও এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। ফলে নির্বাচন কেন্দ্র করে সারা দেশে নগদ অর্থের সরবরাহ বাড়বে আগের চেয়ে কয়েক গুণ।

এদিকে গত মাসের শুরুতে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত বাংলাদেশের অর্থনীতির হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচন কেন্দ্র করে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেগুলো মোকাবিলা করতে পারলে বছর শেষে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে। সেইসঙ্গে অবশ্য নির্বাচনী খরচে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিতেরও তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি। সরকারি বরাদ্দ ছাড়া প্রার্থীদের নিজ নিজ খরচের ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। শাসক দল নির্বাচনী প্রচারণায় বেশ এগিয়ে রয়েছে। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ অন্য দলগুলোও চালিয়ে যাচ্ছে সভা-সমাবেশ। তারাও নানাভাবে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছে যা নির্বাচনী উত্তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে সর্বত্রই। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে যে সহিংসতা হয়েছিল এ বছর তার ব্যতিক্রমই ঘটবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কেননা কোনো রাজনৈতিক দল ও অপশক্তি যেন তৎপরতা চালাতে না পারে সেদিকে তীক্ষ দৃষ্টি রাখছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফলে নির্বাচন কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার তেমন কোনো আশঙ্কা নেই। জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের জন্য সরকার ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ১ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। ২০১৭-১৮ সালে বরাদ্দ ছিল ৯৫৩ কোটি টাকা। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন ৭০০ কোটি টাকা চেয়েছে নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করার জন্য। স্থানীয় নির্বাচন ও অন্যান্য নির্বাচনের জন্য আরও ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে কমিশন। ইতিমধ্যে ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে শহর ও গ্রামের নানা জায়গা। চায়ের দোকানে, মুদি দোকানে, বিলাসবহুল শপিং মলে চলছে নির্বাচনী আড্ডা ও প্রচার-প্রচারণা; যার একটা শক্ত প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। এমনকি ব্যাংক-বীমা, সরকারি-আধাসরকারি অফিস-আদালত সবখানেই চলছে নির্বাচনী আলোচনা। এ ছাড়া নির্বাচন কেন্দ্র করে শহর কিংবা গ্রাম সর্বত্রই কাবিখা, কাবিটাসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে। রাস্তাঘাট, ফুটপাথ সংস্কার ও মেরামতের কাজও এগিয়ে চলছে। স্কুল-কলেজের ভবন নির্মাণসহ ধর্মীয় উপাসনালয়েও বরাদ্দকৃত অর্থছাড়ের জন্য নিজ নিজ এলাকা থেকে জোর তদবির করছেন সম্ভাব্য প্রার্থী ও বর্তমান সংসদের সদস্যরা। এসব ব্যয়ও নির্বাচনী অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে।

তবে নির্বাচন কেন্দ্র নতুন কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য বা বিনিয়োগে আসছেন না আগ্রহীরা। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নির্বাচনের পরই তারা সিদ্ধান্ত নেবেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। নির্বাচনী ইশতেহারে রাজনৈতিক দলগুলো অর্থনীতিকে কতটা গুরুত্ব দেন তাও ভাবার বিষয়; যার ওপর নির্ভর করবে বেকারত্ব নিরসন ও নতুন নতুন চাকরির ক্ষেত্র প্রস্তুতের বিষয়। বিশেষ করে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা ও চলমান বৃহৎ প্রকল্পগুলোর কাজ থেমে না গেলে নির্বাচন-পরবর্তী অর্থনীতিও চাঙ্গা থাকবে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা খরচ করতে পারবেন। সারা দেশে ৩০০ আসনে নির্বাচন হবে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, জাতীয় পার্টি, জাসদ, বাসদসহ অন্যান্য জোট প্রার্থী দেবে এসব আসনে। এতে প্রতি আসনে অন্তত পাঁচজন করে প্রার্থী প্রতিদ্বন্দিতা করবেন। ফলে ১৫০০ প্রার্থী ২৫ লাখ টাকা খরচ করলে নির্দেশিত ব্যয় দাঁড়াবে কমপক্ষে ৩৭৫ কোটি টাকা। কিন্তু ইসির এ নির্দেশনা কখনই প্রতিপালিত হয় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী একেকটি আসনে পাঁচজন প্রার্থী মিলে কমপক্ষে ৪ কোটি টাকা ব্যয় করবেন। আর ঢাকার আসনগুলোর একেকটিতেই ২ থেকে ৪ কোটি টাকা খরচ করবেন একেকজন প্রার্থী। সে হিসেবে প্রার্থীদের খরচ দাঁড়াবে কমপক্ষে ১২০০-১৫০০ কোটি টাকা। এ পরিমাণ অর্থের প্রায় ৯০ ভাগই যাবে গ্রামে। এর বাইরে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব খরচ ধরা হয়েছে ৭০০ কোটি টাকা; যা মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে দেশের অর্থনীতিতে আবর্তিত হবে।

সর্বশেষ খবর