সোমবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
ঐতিহ্য

সীতাকোর্ট বৌদ্ধ মন্দির এখন চারণভূমি

রিয়াজুল ইসলাম, দিনাজপুর

সীতাকোর্ট বৌদ্ধ মন্দির এখন চারণভূমি

পৌরাণিক কাহিনীর জেলা দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার একাধিক ঐতিহাসিক স্থান ও নিদর্শনের মধ্যে প্রাচীন প্রত্নকীর্তি সীতাকোর্ট বৌদ্ধবিহার। বর্তমানে সংরক্ষণের     অভাবে এটির বেহাল দশা। এই প্রাচীন প্রত্নকীর্তি সীতাকোর্ট বৌদ্ধবিহার অযত্ন-অবহেলা আর দেখভালের অভাবে এখন চারণভূমি! প্রাচীন এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে যেমন সংস্কার করা দরকার তেমনি এটি পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হবে। দিনাজপুর জেলা সদর থেকে ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং বিরামপুর থেকে ৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে এবং নবাবগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ২ কিলোমিটার পশ্চিম দিকে বিরামপুরগামী পাকা রাস্তার উত্তর পাশে গোলাপগঞ্জ ইউনিয়নের অন্তর্গত ফতেপুর মাড়াসপুর গ্রামে অবস্থিত সীতাকোর্ট বৌদ্ধবিহার। এটা ফতেপুর মাড়াসপুর গ্রামে প্রায় এক একর আয়তনবিশিষ্ট ভূমির ওপর অবস্থিত। জনশ্রুতি আছে, রামের স্ত্রী সীতা দীর্ঘদিন এ স্থানটিতে বনবাসে ছিলেন বলে এর নাম সীতাকোর্ট। আবার কেউ কেউ একে বলে সীতাকুঠুরি। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি বৌদ্ধবিহার। দিনাজপুর জেলা পরিষদের উদ্যোগে ১৯৬৮ ও ১৯৭২ দুই দফায়  আংশিক খননের পর দেখা গেল এটা সীতার কুঠুরি ছিল না, এটা আসলে ছিল একটি প্রচীন বৌদ্ধবিহার। এ বিহার পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা ২১৪ ফুট, উত্তর-দক্ষিণে প্রস্থ ২১২ ফুট। শৌচাগার ব্যতীত ছোটবড় কক্ষের সংখ্যা ৪১টি। কক্ষে প্রবেশের পথ ৩ থেকে ৫ ফুট প্রশস্ত। এর মূল প্রবেশ পথ উত্তর দিকে।  বিহারের ভিতরে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটি কূপ ছিল, বর্তমানে কূপটি ভরাট হয়ে গেছে। বিহারের বাইরে পূর্ব-দক্ষিণে ৫টি কুঠুরি দেখা যায়। মূল মন্দির ছিল দক্ষিণ দিকের মাঝের স্থানে। প্রত্যেক কক্ষে প্রবেশের একটি মাত্র পথ আছে। পশ্চিম দিকে মাঝের অংশে একটি বড় কক্ষ, তার দক্ষিণ পাশের কক্ষটি খুব ছোট, এর কোনো প্রবেশ পথ নেই। সম্ভবত এটি গুপ্তকক্ষ ছিল। সমগ্র ইমারতের গাঁথুনি চুন সুরকি দ্বারা। লম্বা, মধ্যম ও ছোট তিন ধরনের ইট দেখা যায়। বিহারটিতে দুটি ছোট ব্রোঞ্জ মূর্তি, একটি লোকেশ্বর ও অপরটি মঞ্জুশ্রী এখানে পাওয়া যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন নকশার মাছ, ইট, হাঁড়ি পাতিলের টুকরো, পেরেক ইত্যাদি পাওয়া যায়। বাংলাদেশে আবিষ্কৃত অন্য সব বিহারের চেয়েও এটি প্রাচীন। বর্তমানে বিহারটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিংবদন্তি রয়েছে রামায়নে বর্ণিত রাম এখানেই সীতাকে নির্বাসনে দিয়েছিলেন। তবে এসব বহু লোককথা সীতাকোর্ট বিহারকে নিয়ে থাকলেও প্রকৃত ইতিহাস থেকে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে বিখ্যাত গুপ্তবংশের সম্রাটরা রাজত্ব করতেন। এ দেশে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের তৃতীয় ভাগে সমুদ্র গুপ্তের আমলে গুপ্তবংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত এ দেশে এই বংশের শাসন চলেছিল। যে আমলে এ দেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বহু মানুষ বাস করতেন। লেখাপড়া ও জ্ঞানার্জন ছিল তাদের অন্যতম প্রিয় কাজ। সে সময় গড়ে উঠেছিল বড় বড় সব বিদ্যাপীঠ বা জ্ঞান কেন্দ্র। তখনকার সময়ে এসব স্কুল বা জ্ঞান কেন্দ্রকে বলা হতো বিহার। বিহার মানে সেই জায়গা যেখানে ছাত্ররা বসবাস করতেন ও শিক্ষা গ্রহণ করতেন। যেহেতু তাদের ধর্ম ছিল বৌদ্ধ এবং এখানে বৌদ্ধ ধর্মীয় জ্ঞানও প্রদান হতো। তাই এগুলোকে বলা হতো বৌদ্ধবিহার। এসব বিহারে পড়ানো হতো চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শন, গণিত, রসায়ন, ব্যাকরণ, প্রকৌশল বিদ্যাসহ আধুনিক সব বিষয়। এই বিহারগুলোর কারণেই প্রাচীন বাংলার শিক্ষিত মানুষদের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। তবে এর নির্মাণরীতি দেখে ধারণা করা হয় এটি খ্রিস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতকের দিকে নির্মিত হয়েছিল।

 

সর্বশেষ খবর