শুক্রবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিয়ে প্রতারণা

মির্জা মেহেদী তমাল

বিয়ে প্রতারণা

শাহীন আলম তারেক ওরফে লিটন। ডাক নাম সজীব। তিনি এএসপি সজীব নামে পরিচিত। র‌্যাবে আছেন। বাড়ি  নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার এখলাসপুরে। পোস্টিং তার নারায়ণগঞ্জে। কদিন আগে সজীব বিয়ে করেছেন নারায়ণগঞ্জের সানারপাড়ে। কিন্তু র‌্যাবের কাছে তার সম্পর্কে গুরুতর অভিযোগ আসে। র‌্যাব তাকে গ্রেফতার করে। ব্যাপক জেরার মুখে র‌্যাব জানতে পারে সজীব র‌্যাবের কর্মকর্তা নন। তিনি একজন প্রতারক। বিয়ে প্রতারক। বিয়ে করে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়াই তার কাজ। র‌্যাবের কাছে  স্বীকার করেন, এ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন স্থানে ৯টি বিয়ে করেছেন। সজীব একজন পেশাদার প্রতারক চক্রের সদস্য। তিনি র‌্যাব-১১ এর এএসপি পরিচয়ে দীর্ঘদিন ধরে নারায়ণগঞ্জ এলাকায় সাধারণ লোকের কাছ থেকে উেকাচ গ্রহণ করাসহ বিভিন্ন অপরাধ করছিলেন। র‌্যাব তার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ বিয়ের দাওয়াত কার্ড জব্দ করে। এগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায় কার্ডগুলো তার নিজের বিয়ের, সেখানে বর হিসেবে সজীবের নাম লেখা। দাওয়াত কার্ডগুলোর ওপরে র‌্যাব ও পুলিশের বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম-ঠিকানা লেখা। কখনো তিনি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের এমডি, কখনো করপোরেট হাউসের জিএম। চলাফেরায় বেশ ধুপদুরস্ত। কথাবার্তায় ঝলকে ওঠে হাই ক্লাস সোসাইটির ফুলঝুরি। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার নাম রাব্বী হোসেন চৌধুরী। পুলিশ এই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর তার কাছ থেকে পুলিশ যে তথ্য পায়, তাতে তারাই হতবাক। পুুলিশের একজন কর্মকর্তার মতে, তার মতো এমন স্মার্ট প্রতারক চাকরি জীবনে দেখেননি।

তার টার্গেটে ছিল সমাজের প্রতিষ্ঠিত নারীরা। কথার মোহে ফেলে এই ব্যক্তি প্রথমে তরুণীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেন। পরে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ। এখানেই শেষ নয়। এরপর শুরু হতো দ্বিতীয় পর্ব ভয়ভীতি দেখিয়ে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে অর্থসহ মূল্যবান সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া। একজন বা দুজন নয়, ২৮৬ তরুণীর সর্বনাশ করে তাদের সর্বস্বান্ত করে ছেড়েছেন। আর লক্ষ্যের কথা শুনলে থ বনে যেতে হয়। লক্ষ্য ছিল ৭০০ তরুণীকে ধর্ষণের পর সৌদি আরব যাবেন পরিশুদ্ধ হতে। বিকৃত মানসিকতার প্রচণ্ড ধূর্ত এ প্রতারকের প্রকৃত নাম জাকির হোসেন বেপারি। জাতীয় পরিচয়পত্রে নিজের মর্জি মতো নাম-তথ্যাদি যুক্ত করে বানিয়ে নেওয়া। গত ৮ নভেম্বর রাজধানীর মিরপুরের পাইকপাড়া এলাকার বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সেদিনই ধর্ষণের অভিযোগে এক তরুণী মিরপুর মডেল থানায় জাকিরের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ সময় থানায় উপস্থিত ছিলেন জাকিরের প্রতারণার শিকার আরও চার নারী। তারা সবাই চাকরিজীবী। পরবর্তী সময়ে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জাকির তার প্রতারণার জালের সব কিছু খুলে বলেন। পুলিশ জানায়, প্রতারণা ফাঁদ পেতে তরুণীদের সর্বস্ব লুটে নিতে জাকিরের রয়েছে একটি বিশাল সিন্ডিকেট। সংঘবদ্ধ ওই চক্রে রয়েছেন নকল কাজী ও ইমাম। এ ছাড়া চক্রের কিছু নারী-পুরুষকে নিজের মা-বাবা ও ভাইবোন বানিয়ে জাকির তরুণীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন। এভাবে বিয়ের নামে গত এক বছরে তিনি ২১ ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবী নারীকে ধর্ষণ করেছেন। এরপর অন্তরঙ্গ ছবি তুলে সেগুলো ইন্টারনেটে ছাড়ার হুমকি দিয়ে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইল ও ল্যাপটপ। সম্প্রতি ফেসবুকে বিয়ের নামে আরেকটি প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিলেন তিনি। কিন্তু তার আগেই প্রতারণার শিকার নারীরা তার কার্যক্রম বুঝে ফেলেন। তারা এ নিয়ে ফেসবুকে জাকিরের বিরুদ্ধে একত্রিতও হন।

 বিষয়টি বুঝতে পেরে সম্প্রতি জাকির দাড়ি কেটে ফেলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ৮ নভেম্বর ভুক্তভোগী কয়েকজন তরুণী এক হয়ে তাকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেন। প্রতারণার শিকার এক তরুণী জানান, ফেসবুকের মাধ্যমে চার মাস আগে জাকিরের সঙ্গে তার পরিচয়। এরপর ভুলিয়ে-ভালিয়ে তার সঙ্গে জাকির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। গত ৫ অক্টোবর নিজস্ব সিন্ডিকেটের হুজুর ডেকে তাকে বিয়েও করেন। এর মধ্যেই নানা বিপদের কথা বলে জাকির তার কাছ থেকে তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার হাতিয়ে নেন। জাকিরের প্রতারণার শিকার রাজধানীর গুলশান, উত্তরা, মিরপুর, বারিধারা, মালিবাগ, দক্ষিণখান, খিলগাঁওসহ বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় অসংখ্য ভুক্তভোগী তরুণী রয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই জাকিরকে শনাক্ত করে প্রতারক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ভুক্তভোগী তরুণীদের মাধ্যমে পাওয়া গেছে জাকিরের তিনটি বিয়ের কাবিনসহ তার প্রতারণায় ব্যবহৃত অসংখ্য ছবি, ফেসবুকের চ্যাটবক্সে কথোপকথনের স্ক্রিনশট ও ভিডিওক্লিপ। পুলিশের কাছেও বিয়ের নামে প্রতারণার চাঞ্চল্যকর তথ্য জানিয়েছেন জাকির।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর