রবিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিদেশ নামের জেলখানা

মির্জা মেহেদী তমাল

বিদেশ নামের জেলখানা

‘বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার পর সেখানে একটি বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করি। প্রথম দিনেই আমি টের পেয়েছিলাম যে আমার কপালে মনে হয় কষ্ট আছে। ঠিক সেটাই হলো! সারা দিন কাজ করতাম। কিন্তু খাবার জুটত না। এই চার মাসে এক মুঠো ভাত কপালে জোটেনি। চা আর রুটি খেয়ে থেকেছি। একসঙ্গে দশটা/বিশটা কাজের হুকুম দিত তাও আবার সময় ধরে। সময়মতো কাজ না হলে গৃহকর্তা বেল্ট দিয়ে মারত, গরম ইস্তিরি দিয়ে ছ্যাঁকা দিয়ে আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় দাগ করে দিয়েছে। আর চড়-থাপ্পড় তো প্রতিদিনের বিষয় ছিল। ঘর থেকে বের হওয়ার, এমনি কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হতো না। আমি চিড়িয়াখানার জন্তুর মতো সবসময় ছটফট করতাম। ১০ দিন আগে বাসা ফাঁকা থাকায় কোনোমতে পালিয়ে বের হয়ে আসি। এরপর পুলিশের কাছে যাই। তারা আমাকে দেশে আসতে সাহায্য করেছে। পরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সহায়তায় দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত দাম্মামের খোবার এলাকার একটি সেইফ হোমে নেওয়া হয়। সেখানে গিয়ে দেখি আমার মতো অনেক নারী রয়েছেন। এরপর আমরা সেখানে থাকতে আর রাজি না হওয়ায় দূতাবাস আমাদের ফেরত আনার ব্যবস্থা করেছে।’ ভাগ্য ফেরাতে সৌদি আরবে পাড়ি দেওয়া শরীয়তপুরের কুলসুম বেগমের জবানবন্দি এসব।

স্বামী ও চার সন্তানের এই জননী কুলসুম পরিবারের মায়া ভুলে সামান্য রোজগারের আশায় যান সৌদি আরব। কিন্তু সেটি ছিল কার্যত এক জেলখানা। দীর্ঘ চার মাস সেখানে তাকে সহ্য করতে হয়েছে নির্মম পাশবিক অত্যাচার। মাত্র তিন দিন আগে শরীরে জখম নিয়ে ফিরেছেন এই নারী। তার চোখে-মুখে সেই বর্বর নির্যাতনের ছাপ স্পষ্ট। কান্নাজড়িত কণ্ঠে কুলসুম জানান, ‘ভালো ইনকাম করব এই আশায় সংসার-সন্তানাদি ছেড়ে গিয়েছিলাম সৌদিতে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ আমি সর্বস্বান্ত। এই চার মাসে কোনো টাকা পাইনি। খালি হাতে ফিরতে হলো।’ ২৭ মে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে আসেন আরেক নারী কেরানীগঞ্জের মল্লিকা। এই নারী ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তার গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীর কাছে। তিনি বলেন, ‘সেখানে প্রতিদিন আমাকে নির্যাতন করা হতো। খেতে দেওয়া হতো না। কাজে কর্মে একটু ভুলত্রুটি হলেই আটকে রেখে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হতো। পাশাপাশি রড গরম করে ছ্যাঁকা পর্যন্ত দেওয়া হতো। গৃহকর্তা মাঝে মাঝে আমাকে ধর্ষণ করত। কিছু বলতে গেলেই গরম রডের ছ্যাঁকা দিত। বাংলাদেশে ফিরে আসার কথা বললেই বলত, আমরা তোকে কিনে এনেছি তিন লাখ টাকা দিলে ছেড়ে দেব। প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বললেও টাকা পাইনি। খালি হাতে ফিরতে হয়েছে বাংলাদেশে।’

কুলসুম ও মল্লিকার মতো অনেক নারী প্রতিদিন সৌদি আরব থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসছেন এবং এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। দেশে ফিরে এসব নারী নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনা দিচ্ছেন। ভাগ্য বদলাতে যে নারীরা বিদেশে যাচ্ছেন একটু সুখের আশায় সেখানে তাদের কপালে জুটছে ভয়াবহ শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের মতো জঘন্য ঘটনা। গৃহকর্তার ধর্ষণের শিকার হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে দেশে ফিরেছেন কেউ, কাউকে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে, প্রতিবাদ করায় এক নারীর চুল টেনে টেনে তুলে ফেলা হয়েছে, নির্যাতনের কারণে চার তলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে একজন হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলেন অনেক দিন, অনেকেই যৌন নিপীড়নের শিকার। এমন অভিযোগও রয়েছে, পিরিয়ড চলাকালে মালিকের পাশবিকতায় ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন শ্রমিক হয়ে সৌদি আরব যাওয়া অনেক নারী। যার ফলে অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন। আবার নির্যাতিতদের অনেককেই পরিবার গ্রহণ করতে চাচ্ছে না।

সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই নারী শ্রমিকদের পাঠানো উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘প্রত্যেক নারী কর্মীকে যাওয়ার সময় মোবাইল ফোন দেওয়া উচিত। কারণ, মেয়েরা ঘরে কাজ করবে। এ ছাড়া মাসে অন্তত একবার দূতাবাসের পক্ষ থেকে মেয়েদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা উচিত। এজন্য দূতাবাসে লোকবল বাড়ানো কিংবা প্রয়োজনে বেসরকারি সংস্থাগুলোর সহায়তা নেওয়া উচিত। কারণ, আমরা চাই না কোনোভাবেই আমাদের মেয়েরা নির্যাতিত হোক।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর