বুধবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

নীরব সড়কে ভয়ঙ্কর ওরা

মির্জা মেহেদী তমাল

নীরব সড়কে ভয়ঙ্কর ওরা

বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অসুস্থ মাকে দেখে কবির তার স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন। তারা শাহবাগ মোড়ে বাসের অপেক্ষায়। কিন্তু অনেক রাত হওয়ায় বাস পাচ্ছিলেন না। কবির তার স্ত্রীকে নিয়ে একটি রিকশা নেন। ফার্মগেট পর্যন্ত যাবেন। সেখান থেকে অন্য কোনো উপায় বের করে মিরপুর যাওয়ার পরিকল্পনা তার। রিকশা যখন ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের সামনে আসে তখন রাত সাড়ে ১২টা। রাস্তা একদম ফাঁকা। লোকজন কম। আবারও বাসের অপেক্ষা তাদের। সিএনজি কয়েকটা থাকলেও অতিরিক্ত ভাড়া চাওয়ায় যাচ্ছিলেন না তারা। ফুটপাথে তারা দাঁড়িয়ে আছেন। কবিরের স্ত্রীর চোখ রাস্তার দিকে। কবিরও তার পাশেই দাঁড়ানো। এমন সময় একজন বোরকা পরা মহিলা কবিরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে চিৎকার শুরু করলেন। বলতে থাকেন, এই মিয়া আমার গায়ে হাত দিলা কেন? হতবাক কবির। কিছু বলতে পারছেন না। তার স্ত্রী পাশ ঘুরেই দেখেন বোরকা পরা মহিলা তার স্বামীর সঙ্গে চিৎকার চেঁচামেচি করছেন। তিনি তাকে বলেন, বোন কী হয়েছে। চিৎকার করছেন কেন। মহিলা তাতে আরও ক্ষেপে যান। বলেন, এই ব্যাটা আমার শরীরে হাত দিছে। কবির তখন কথার মাঝে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। বলছেন, এই মহিলা, কী বলছেন আবোল তাবোল। আমি কখন আপনার শরীরে হাত দিলাম! তার স্ত্রী কবিরের দিকে তাকিয়ে আছেন। কবির এখন মহা বিপদে। তার স্ত্রী আবার বিশ্বাস করে ফেলল নাকি? তিনি এবার তার স্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। কোথা থেকে এই মহিলা এসে ফালতু কথা বলছে। তার স্ত্রী চোখ গরম করে বলেন, হ্যাঁ হইছে, মহিলা তাহলে এভাবে বলছেন কেন? একজন দুজন করে মানুষ ভিড় করতে থাকে। কবির বোঝানোর চেষ্টা করছেন, এই মহিলা তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। বোরকা পরা মহিলার চিৎকার থামে না। আশপাশের লোকজনকে অভিযোগ করতে থাকে। ভিড়ের মধ্যে থাকা ২/৩ ব্যক্তি বোরকা পরা মহিলার পক্ষ নেন। বলেন, তারাও পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছে যে, লোকটি বোরকা পরা মহিলার কাছাকাছি ঘেঁষে শরীরে হাত দিয়েছে। একথা বলেই তারাও কবিরকে যা-তা বলছেন। একজন মহিলার সঙ্গে থেকেই আরেক মহিলার শরীরে হাত দেওয়া, এটা কী ধরনের। আরও নোংরা ভাষায় তারা গালাগাল শুরু করে। লোকজনের এমন কথায় কবিরের স্ত্রী যেন আরও বিপদে পড়লেন। তিনি তার স্বামীর হাত ধরে একটি সিএনজিতে ওঠার চেষ্টা করলে ওই মহিলাসহ লোকজন তাদের বাধা দেয়। কবিরের স্ত্রী হাতজোড় করে মাফ চান তার স্বামীর জন্য। কিন্তু কবির তার স্ত্রীকে বলতে থাকেন, মাফ চাচ্ছ কেন। আমি তো কিছু করিনি। কিন্তু তার কথা কেউ শুনছেন না। যারা বোরকা পরা মহিলার পক্ষ নিয়েছিলেন, তারা বলতে থাকে, আপনারা এভাবে যেতে পারবেন না। থানায় যেতে হবে। এতে অবাক কবির এবং তার স্ত্রী। বলে কী! থানায় যেতে হবে কেন? জানতে চন কবির। তারা বলেন, রাস্তায় মেয়ে দেখলে খারাপ আচরণ করবেন, আর থানায় যাবেন না, এটা হয় নাকি? চলেন তেজগাঁও থানায়। এ সময় লোকজনের মধ্যে একজন মোবাইল ফোনে কল করতে থাকে থানায় পুলিশ ডাকার জন্য। এ সময় কবির আর তার স্ত্রী ঘাবড়ে যান। কবিরের স্ত্রী বলেন, ভাই এগুলো কইরেন না। আমরা পা ধরছি। আমাদের ছেড়ে দেন। আমার স্বামীর ভুল হয়েছে। তখন একজন কবিরের স্ত্রীকে একটু পাশে নিয়ে ফিস ফিস করে কথা বলেন। কবিরের স্ত্রী তাকে বলেন, না ভাই, আমাদের কাছে টাকা নেই। আমরা হাসপাতাল থেকে রোগী দেখে এসেছি। তখন লোকটি বলেন, ভালো বুদ্ধি দিছি আপনাকে। বুদ্ধি না নিলে থানায় যান। ওই মহিলা মামলা করবে আপনার স্বামীর বিরুদ্ধে। তখন ওই মহিলা থানায় যাবে বলে হাঁটতে শুরু করে। এ সময় কবিরের স্ত্রী তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, আপা আমাদের কাছে টাকা বেশি নেই। আমাদের কাছে ৫ হাজার টাকা নেই। তখন বোরকা পরা মহিলা বলেন, কত আছে? কবিরের স্ত্রী বলেন, ২ হাজার আছে। বোরকা পরা মহিলা বলেন, যদি আরও বেশি থাকে তাহলে সব দিয়ে যেতে হবে। কবিরের স্ত্রী বলেন, ঠিক আছে। কবিরের স্ত্রী তার ব্যাগ থেকে এক হাজার টাকা বের করে। আর তার স্বামীকে বলে আরও এক হাজার টাকা দিয়ে দিতে। কবির মানিব্যাগ থেকে এক হাজার টাকা বের করে দেয়। বোরকা পরা মহিলা টাকা নিয়েই কবিরের স্ত্রীর কাছ থেকে ব্যাগটি ছিনিয়ে নেয়। বলে, দেখি আরও টাকা আছে কিনা? ব্যাগ খুলেই দেখে আরও ৩টা ৫০০ টাকার নোট। তখন মহিলা গালাগাল করতে থাকে। বলে, এই মহিলা এই যে আরও টাকা আছে। সেই দেড় হাজার টাকাও নিয়ে নেয় বোরকা পরা মহিলাটি। টাকাগুলো নিয়ে খুব দ্রুত বোরকা পরা মহিলা ও তার সহযোগী ৩ ব্যক্তি ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। এ সময় টং দোকানের লোকজন তাদের বলতে থাকে, ওরা এখানেই প্রতিরাতে নিরীহ লোকজন ধরে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে যায়। তখন তাদের কবির বলে, তারা কেন বাধা দিল না। দোকানদার জানায়, তারা সংঘবদ্ধ চক্র। তারা বাধা দিতে গেলে আর দোকানদারি তাদের করতে হবে না সেখানে। টাকা খুইয়ে কবির দম্পতি একটি সিএনজিতে চড়ে তাদের গন্তব্যস্থলের দিকে চলে যায়। রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকার মধ্যে ফার্মগেট অন্যতম। দিনের বেলায় মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকে এ এলাকা। তাই দেখে হয়তো অনেক কিছুই বোঝা যায় না। কিন্তু রাতের নীরবতা যত বাড়ে, ততই এই এলাকায় আনাগোনা বাড়ে দেহ ব্যবসায়ী নামের ভয়ঙ্কর চক্রের। তারা তৎপর হয়ে ওঠে। খদ্দেরের খোঁজে বোরকা পরে অপেক্ষা করতে দেখা যায় তাদের রাস্তার ধারে। এরাই আবার ফাঁদ পেতে টাকা নেয়। প্রায় প্রতিরাতেই এমন ফাঁদ পেতে টাকা পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। লাজ লজ্জার ভয়ে কেউ খুব একা অভিযোগ করে না। শাহীন নামের একজন সিগারেটের দোকানদার বলেন, আমি এই জায়গাতে দোকান করি গত চার বছর ধরে। এদের (পতিতা) প্রতি রাতেই দেখি। ভোরে আবার চলে যায় তারা। তিনি বলেন, এদের সিএনজি চালকও ঠিক করা থাকে। খদ্দের ঠিক হলেই সিএনজি করে চলে যায়। অনেক সময় সিএনজিতেই তারা এ কাজ করে। তারা সিএনজিতে নিয়ে খদ্দেরকে প্রতারণা করে, টাকা, মোবাইল ফোন ছিনতাই করে। মান-সম্মানের ভয়ে অনেকেই তা প্রকাশ করে না। মাঝে মধ্যে পুলিশ এদের ধরে নিয়ে যায়। আবারও আগের অবস্থায় চলে আসে। আনন্দ সিনেমা হলের আশপাশে পুলিশের গাড়ি থাকে। কিন্তু তারা সেটা কেয়ার করে না। ফার্মভিউ মার্কেটের সামনে কখনো আনন্দ হলের উত্তর পাশের রাস্তায় তারা এমন ফাঁদ পাতে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর