রবিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

কোমলমতির চরম সিদ্ধান্ত

মির্জা মেহেদী তমাল

কোমলমতির চরম সিদ্ধান্ত

ঘুম থেকে উঠেই মালিহা স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। তার মা তাকে নাস্তা দিতে যেয়ে দেখতে পান, মেয়েটি খাবার টেবিলে মাথা নিচু করে ঘুমিয়ে পড়েছে। মা তাকে ডেকে তোলেন। কিন্তু মেয়ের চেহারা দেখে বুঝতে বাকি থাকে না মায়ের। মেয়ের জ্বর। কপালে হাত দিয়ে দেখেন ভীষণ জ্বর মেয়ের। মেয়েকে বলেন, স্কুলের কাপড় চেঞ্জ করে শুয়ে থাকতে। কিন্তু মেয়ে স্কুলে যাবেই। তাকে আটকানো যাচ্ছে না। মেয়ের বাবা তাকে বুঝিয়ে সেদিন বাসায় রাখে। কিন্তু পরদিন শরীর পুরো ভালো না হলেও মালিহা ঠিকই স্কুলে যায়। ঝড় বৃষ্টি যাই হোক না কেন, মালিহা স্কুলে যাবেই। এ ব্যাপারে মালিহার কোনো আপস নেই।

হঠাৎ স্কুলের প্রতি অনীহা মালিহার। ঘুম থেকে উঠতে চায় না। স্কুলের নাম শুনলেই নানা বাহানা তার। আজ মাথা ব্যথা, কাল পেট ব্যথা। নানা উসিলায় মালিহা স্কুল যাওয়া থেকে বিরত থাকতে চায়। তার বাবা-মা জোর জবরদস্তি করে তাকে স্কুলে পাঠান। বাবা মাকে ভাবিয়ে তোলে তার এই পরিবর্তন। মেয়েকে প্রশ্ন করেন মা, কী রে, স্কুলের সময় হলেই তুই কেন অসুস্থ হয়ে পরিস! মেয়ে প্রথমে কিছু বলে না। পরে বলে, তার ভালো লাগে না স্কুলে যেতে। স্কুলের রিমি ম্যাডাম, আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। এই জন্য স্কুলে যেতে ইচ্ছা হয় না। মেয়ের এমন কথা শুনে রেগে যান মা। বকাঝকা করেন। মেয়ে বুঝানোর চেষ্টা করে। বোঝেন না মা।

সুমাইয়া আক্তার মালিহা। বয়স ১৪। দশম শ্রেণির ছাত্রী। এক রাতে এই মেয়েটির লাশ উদ্ধার হয় সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায়। তার ঘরের বিছানা থেকে উদ্ধার করা হয় একটি ‘সুইসাইড নোট’। নোটে মালিহার হাতের লেখা। তাতে লেখা আছে, ‘আমার সুইসাইড করার কারণ একমাত্র রিমি ম্যাডাম। সে অযথা পরীক্ষায় আমার খাতা নিয়েছে। আর পরীক্ষায় কম নম্বর দিয়েছে। তোমরা যদি পার তাহলে সেই ম্যাডামকে মানসিক চিকিৎসা দাও, মেন্টাল হসপিটালে পাঠাও। ম্যাডাম আমারে অভিশাপ দিয়েছে, তাই আমার ভালো রেজাল্ট খারাপ হয়েছে।’ রুল করা কাগজে দশম শ্রেণির ছাত্রী মালিহা আত্মহত্যার আগে লিখে গেছে তার কষ্টের কথা। লিখেছে সে কেন মৃত্যুর পথ বেছে নিল।

সন্তান হারিয়ে মালিহার পরিবার পাগল প্রায়। মা বুকচাপড়িয়ে কাঁদছিলেন, আর বলছিলেন— কেন মেয়ের কথা আমি শুনলাম না! মা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তার সন্তানের কথাগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এই উপলব্ধি করাটা হয়েছে অনেক দেরিতে। রাজধানীর শাহজাহানপুর থানা পুলিশ এই সুইসাইড নোট এবং প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে শিক্ষক রিমি আক্তারকে গ্রেফতার করে। ঘটনাটি কয়েক মাস আগেকার। গত সপ্তাহে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় হয়। শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয় এ ঘটনায়। আরও দুজনকে গ্রেফতারের জন্যে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। নিজের ঘরে গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করে ৯ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ওই শিক্ষার্থী পরীক্ষায় নকল করে রবিবার ধরা পড়েছিলেন বলে বিদ্যালয়টির অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। ওই ঘটনার পর অরিত্রীর বাবা-মাকে ডেকে নিয়ে ‘অপমান করেছিলেন’ অধ্যক্ষ। সেই কারণে এই কিশোরী আত্মহত্যা করেন। এমন অবস্থা এখন সারা দেশের। আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ছে দিন দিন। বিশেষ করে স্কুলগুলোতে এমন ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, স্কুলগুলোতে নিয়োগ দেওয়ার মতো বাংলাদেশে অত চাইল্ড সাইকোলজিস্ট নেই। তাই প্রয়োজন স্কুলের শিক্ষকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া। তারা যাতে বিষয়টি বুঝতে পারেন। তারা যেন জানেন, শিক্ষার্থীদের প্রতি কেমন আচরণ করতে হবে, কোন শিক্ষার্থী কোন ধরনের আচরণ নিতে পারবে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে কোনো নেতিবাচক প্রবণতা থাকলে তাদের সেই অনুযায়ী চিকিৎসকের কাছে পাঠাতে হবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, ‘শিক্ষা হবে আনন্দের মধ্য দিয়ে। শিশুরা পড়াশোনা বা পরীক্ষাকে ভয় পাবে না। এটাই শিক্ষার আধুনিক কৌশল। কিন্তু আমাদের এখানে এর উল্টো ব্যবস্থা চলছে। শিক্ষার্থীদের নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক চাপে রাখা হয়। আর এর ফলে অনেক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে এরকম অভিযোগও আছে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের কাছে বা কোচিংয়ে না পড়লে তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়।’ তৌহিদুল হক বলেন, পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে শিক্ষার্থীরা অনেক মানসিক চাপে থাকে। এটা দূর করতে হবে। উন্নত বিশ্বে এই পরিস্থিতি এড়াতে পরীক্ষার ফল শিক্ষার্থীকে এককভাবে জানানো হয়। যাতে সে তার ক্লাসমেট বা বন্ধুদের কাছে খারাপ ফলের জন্য হেয় বা অপমানিত না হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর