মঙ্গলবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

দ্বন্দ্বের বলি শিশুরা

মির্জা মেহেদী তমাল

দ্বন্দ্বের বলি শিশুরা

নুসরাত জাহান। বয়স হয়েছিল মাত্র সাত বছর। কিন্তু এই বয়সেই ফুটফুটে মেয়েটিকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। না, কোনো রোগে ভুগে বা দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়নি নুসরাতের। তাকে হত্যা করা হয়েছে নির্মমভাবে। মারা যাওয়ার আগে পৃথিবীর কুিসততম রূপটি সে দেখেছে। চোখের সামনে বাবাকে সে খুন হতে দেখেছে। আর এ জন্যই বাঁচতে পারেনি সে-ও।

রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা দুই সন্তানের মা আরজিনা বেগম প্রেমে পড়েছিলেন এলাকারই এক রংমিস্ত্রি শাহিনের। তাদের ছিল কঠিন প্রেম। কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারছিলেন না। তাই দুজনে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পথের কাঁটা হিসেবে যিনি রয়েছেন, তিনি আরজিনার স্বামী জামিল শেখ। কাঁটা তো সহজেই দূর করা যায়। খুন করে ফেলা। তাই তারা করেছেন। কিন্তু তা দেখে ফেলেছিল আরজিনার বড় সন্তান নুসরাত, চিৎকার করে জানতে চেয়েছিল, কেন তার বাবাকে মারা হচ্ছে। না, পাপের কোনো সাক্ষী রাখতে চাননি তারা। তাই শ্বাসরোধ করে ও বালিশচাপা দিয়ে নুসরাতকে মেরে ফেলেন শাহিন। গ্রেফতারের পর পুলিশের কাছে এসব কথা বলেছেন আরজিনা ও শাহিন। পরকীয়া প্রেমের জের ধরে দুই শিশু সন্তানের গায়ে আগুন দিয়েছে মা। এতে হৃদয় হোসেন (৯) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। অপর শিশু জিহাদ হোসেন শিহাব (৭) আশঙ্কাজনক। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার উচিতপুরা ইউনিয়নের বাড়ইপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। পরে মা শেফালী আক্তারকে (২৮) গ্রেফতার করে পুলিশ। রৌমারীতে এক প্রবাসীর স্ত্রীর ‘পরকীয়ার’ বলি হয় দুই শিশু। এদের মধ্যে আয়শা সিদ্দিকা (৩) ও একদিন পর সাত মাস বয়সের রাকিবুল হাসানের মরদেহ নদী থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ওই দুই শিশুর দাদি শাহাতন বেওয়া বাদী হয়ে নিহত ওই শিশুর মা, তার কথিত প্রেমিক ফরহাদ হোসেনসহ ১২ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ শিশু দুটির মা, তার কথিত প্রেমিক ফরহাদের বাবা হাছেন আলী, পাটাধোয়াপাড়া গ্রামের মাতব্বর ওমেদ আলীকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠিয়েছে। টঙ্গীতে পরকীয়ার বলি হয়েছে শিশু আদনান হোসেন আপন (৭)। মায়ের অপকর্ম দেখে ফেলাই কাল হলো তার। আটক আঁখি আক্তার পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে তার প্রেমিক মিন্টু মিয়া ও তার সহযোগীরা শিশু আদনানকে গলাকেটে হত্যা করে বলে স্বীকার করেন। ঘরে-বাইরে অব্যাহতভাবে নির্যাতন-নৃশংসতার শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। বাবা-মায়ের দাম্পত্য কলহ, পরকীয়া, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, অর্থ-বিত্ত-বৈভব ও ক্ষমতা নিয়ে বড়দের দ্বন্দ্বের বলি হচ্ছে তারা। প্রতিরোধের ক্ষমতা নেই বলে মাদকাসক্তরাও শিশুদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। এ অবস্থাকে দেশের ভবিষ্যতের জন্য ‘ভয়ঙ্কর’ আখ্যায়িত করে সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, শিশুদের সুরক্ষায় দেশে আইন থাকলেও এর সঠিক প্রয়োগ নেই। ফলে দু-একটি ঘটনায় বিচার পেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে বিচার কার্যক্রম। এই  কারণেই দেশে শিশুদের ওপর নৃশংসতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তারা আরও বলেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এবং দেশের ভবিষ্যতের স্বার্থেই শিশুদের প্রতি যে কোনো নৃশংসতার দ্রুত বিচার ও রায় হওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে এসব বিচার ও রায়ের খবর ফলাও করে প্রচার করা দরকার। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন,  শিশুরা নিরীহ, দুর্বল। তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না। এ সুযোগই কাজে লাগাচ্ছে খুনিরা। তারা প্রতিপক্ষের ওপর যে কোনো বিষয়ে প্রতিশোধ নিতে নির্যাতন-হত্যা করছে শিশুদের। তিনি বলেন, যেসব মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ নেই, সেসব পাষণ্ডই এসব নির্মম ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। আবার অনেকে সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে শিশুদের ওপর নির্যাতন শুরু করে। তিনি বলেন, শিশুদের ওপর প্রতিটি নৃশংসতার বিচার দ্রুত হওয়া উচিত। একই সঙ্গে বিচারের রায় ফলাও করে প্রচার করলে অন্যরাও ভয় পাবে। কমে আসবে শিশুদের ওপর নির্যাতন ও নৃশংসতা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর