বৃহস্পতিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ব্যাংক খাতে সংকট নেই, ঋণ দিলে খেলাপি হবেই : এবিবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশে কার্যরত তফসিলি ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) চোখে ব্যাংক খাতে তেমন কোনো সংকট নেই, আছে কেবল সাফল্য আর স্বাস্থ্যোজ্জ্বল অর্জন। গত ১০ বছরে ব্যাংক খাতে ডিপোজিট বেড়েছে, রেমিট্যান্স আয়ে উল্লম্ফন ঘটেছে, বিনিয়োগ বেড়েছে। ঋণের পরিমাণও বেড়েছে বহুগুণ।

গতকাল রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের সামনে এসব তথ্য তুলে ধরেন সংগঠনের নেতারা। তারা বলছেন, ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতাও বেড়েছে। এমনকি ছোট এবং মাঝারি ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলার মতো সক্ষমতা রয়েছে দেশের ৭৫ শতাংশ ব্যাংকের। তবে খেলাপি ঋণও বেড়েছে, কিন্তু সেটা নতুন কোনো সংকট নয়। খেলাপি ঋণ আগেও ছিল, বর্তমানে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। আর এই ঋণ খেলাপি সৃষ্টির জন্য ঋণগ্রহীতার পাশাপাশি ব্যাংকাররাও অনেকাংশে দায়ী বলে স্বীকার করেন এমডিরা। তারা বলেছেন, ঋণ দিলে খেলাপি হবেই, এটা মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাংক খাত থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বেরিয়ে গেছে— এমন তথ্যও সঠিক নয় বলে মনে করেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। সংবাদ মাধ্যমে ব্যাংক খাতের নেতিবাচক দিকগুলো ফলাওভাবে প্রচার করা হলেও তাদের সাফল্য আর অর্জনগুলো সেভাবে উঠে আসে না বলে তাদের অভিযোগ। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাতের অর্জনগুলো লিখিত বক্তব্যে তুলে ধরেন এবিবির চেয়ারম্যান, ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। এরপর সাফল্য তুলে অন্তত আরও ১০ জন এমডি বক্তব্য রাখেন। এই সংবাদ সম্মেলনে সম্প্রতি ব্যাংক খাত থেকে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লুটপাটের বিষয়ে সিপিডির প্রকাশ করা তথ্য নিয়ে ঘুরে ফিরে বিষোদগার করেন এমডিরা। লিখিত বক্তব্যে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। দশ বছর আগে ছিল ৮৭ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। এই বাজেটের আকার বেড়ে হয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতির আকার বহুগুণ বেড়েছে। ব্যাংক খাতসহ সবাই মিলে এ উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু সবসময় নেতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা হয়। কাজ করতে গেলে ভুলভ্রান্তি হতেই পারে। যেসব নিউজ সংবাদমাধ্যমে আসে তা একটি নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করে। ব্যাংক খাতে অনেক সাফল্য আছে তা নিয়েও কথা বলা উচিত। এ সময় ব্যাংকের এমডিরা গত দশ বছরের ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন সাফল্য তুলে ধরেন। তবে এক লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ এবং সংঘটিত অনিয়ম সম্পর্কে তারা কোনো তথ্য দেননি।

এসব বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, ব্যাপক অর্জনের মধ্যে কিছু অনিয়ম হয়েছে।

সিপিডি প্রকাশ করা তথ্য নিয়ে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করা হয়নি দাবি করলেও এবিবির নেতারা বলেন, গবেষক ও বিশ্লেষকদের নেতিবাচক বিশ্লেষণ আমাদের পীড়া দেয়। তাদের উচিত আমাদের অর্জন নিয়েও কথা বলা। ব্যাংকের কোনো ইস্যুতে সাধারণত এবিবি এ ধরনের সংবাদ সম্মেলন করে না। ৫ বছর আগে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর নিয়ে একবার সংবাদ সম্মেলন করেছিল এবিবি। নির্বাচনের আগে কেন এই সংবাদ সম্মেলন এমন প্রশ্নের জবাবে এবিবি চেয়ারম্যান বলেন, এর সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি সিপিবির ওই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানান মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, এটা আগে থেকেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল বিজয়ের মাসে স্বাধীনতার ৪৭ বছরের অর্জন সম্পর্কে জানানোর জন্য এমন একটি আয়োজন করা হবে। তার অংশ হিসেবেই এই সংবাদ সম্মেলন করা হলো। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে ব্যাংক খাতের অবদান তুলে ধরে ব্যাংক এশিয়ার এমডি মো. আরফান আলী বলেন, ব্যাংকের আকার অনেক বড় হয়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং চালু করার ফলে অনেক মানুষ সেবা পাচ্ছেন। ব্যাংকগুলোর ১০ হাজার শাখা, ৭৫৮টি ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান, ৩৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ১৭টি বীমা ও ৮২ হাজার ৩৪৬টি সমবায় সমিতি গড়ে উঠেছে। এর ফলে ব্যাংকিংয়ে সবাই আসছে। ২০১৩ সালে ১ লাখ মানুষের জন্য শাখা ছিল ৮টি, এখন বেড়ে হয়েছে ৯টি, এটিএম ছিল ৫টি, এখন বেড়ে হয়েছে ৮টি, মোবাইল অ্যাকাউন্ট ছিল ১৮৬টি এখন বেড়ে হয়েছে ৬৬৭টি। বর্তমানে ৫০ শতাংশ মানুষের অ্যাকাউন্ট আছে যেখানে ২০১৪ সালে ছিল ৩১ শতাংশ। মোট অ্যাকাউন্টের ৩৫ শতাংশ নারীদের। অর্থাৎ সবক্ষেত্রে উন্নয়ন হয়েছে। আইএফআইসি ব্যাংকের এমডি শাহ এ সারওয়ার বলেন, দেশের অর্থনীতির ব্যাপক উল্লম্ফন হয়েছে। ঐতিহ্যগত বিনাপুঁজি থেকে আমরা পরিশ্রম করে অর্থনৈতিকভাবে অনেক উন্নতি করেছি। এর পেছনে ব্যাংকগুলো অর্থায়ন করে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। কিছু ভুলের কারণে শুধু নেতিবাচক আলোচনা করা উচিত নয়। অগ্রণী ব্যাংকের এমডি শামস উল ইসলাম বলেন, ব্যাংকিং খাতে অকল্পনীয় অগ্রগতি হয়েছে। ব্যাংক খাত শক্তিশালী বলেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি ভালো হচ্ছে, নিজের টাকায় পদ্মা সেতু করা সম্ভব হচ্ছে। এসব উন্নয়নের চিত্র নিয়ে আমরা বাহাস করতে চাই। যে কেউ আমাদের সঙ্গে বাহাস করতে পারেন। ইসলামী ব্যাংকের এমডি মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকের চেষ্টার ফলে উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে উঠেছে। স্বাধীনতার সময় ব্যবসা-বাণিজ্য ২২ পরিবারের হাতে ছিল। ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর পোশাক খাতসহ বড় বড় শিল্প ব্যাংকের হাত ধরে বড় হয়েছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে আনিস এ খান বলেন, বিভিন্ন কারণে ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। একসময় ছিল কারখানার জন্য ব্যাংক ঋণ নিয়ে যন্ত্রপাতি বসিয়ে গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে তা চালু করতে পারেননি উদ্যোক্তারা। নিত্যপণ্য আমদানি করে তার দাম পড়ে যাওয়ায় লোকসানে পড়তে হয়েছে। ফলে ঋণগ্রহীতারা খেলাপি হয়ে গেছেন। সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকের অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। কিন্তু সব সময় সমস্যা বললে কাজ করা যাবে না। পজিটিভ চিন্তা করে কাজ করতে হবে। প্রত্যেক বছরই চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। তবে ব্যাংক খাতের জন্য সরকার নানাভাবে সহযোগিতা করছে। একটি ব্যাংক সফল হতে সময় লাগে ১০০ থেকে ১৫০ বছর। সুতরাং আমরাও সফল হব। আলোচিত কেলেঙ্কারি হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংকসহ দুর্নীতির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে, হলমার্ক গ্রুপের জমি ছিল, কারখানা ছিল, বিদেশি ক্রেতা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কোনো এক কারণে ‘হায় হায়’ করতে করতে সব চলে গেল। স্বল্প মেয়াদি ঋণগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে করতে গেলে কিছুটা সমস্যা হয়। ঋণ দিলে খেলাপি হবেই। এটাকে মেনে নিয়েই কাজ করতে হবে। তবে সেটাতে সহনীয় ও নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখতে হবে বলে জানান এমডিরা। ইস্টার্ন ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার বলেন, ব্যাংকিং খাতে ঋণ বিতরণের ঝুঁকি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আমাদের সক্ষমতা কতটুকু আছে এটাই দেখার বিষয়। আমরা যদি ঝুঁকিপূর্ণ ঋণকে (ছোট, মাঝারি ও বড়) তিন ভাগে ভাগ করি তাহলে দেখা যাবে। বর্তমানে ছোট আকারের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ মোকাবিলায় দেশের সব ব্যাংকের সক্ষমতা রয়েছে। আর মাঝারি আকারের ঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষম ৭০ শতাংশ ব্যাংক। তবে বড় ঝুঁকির ক্ষেত্রে সবাই সক্ষম নয়। খেলাপি ঋণ হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের চেয়ে ঋণ গ্রহীতারা বেশি দোষী উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা সব কিছু দেখে ঋণ দেই, তারা ফেরত দেয় না। তাহলে দোষ কাদের? আর ব্যাংক খাতের খোয়া যাওয়া ২২ হাজার কোটি টাকার সম্প্রতি সিপিডির তথ্য পুরো সত্য নয়। ব্যাংক এশিয়ার এমডি মোহাম্মদ আরফান আলী বলেন, এক সময় ব্যাংকিং খাতে ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ সেবা বিনামূল্যে দেওয়া হতো। বর্তমানে ৬৬ শতাংশ সেবা বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। বর্তমানে স্কুল ব্যাংকিং, ১০ টাকার হিসাব খোলা সবক্ষেত্রে আমরা সফল। যার কারণে অর্থনীতির উন্নয়নে ব্যাংক রোল মডেল হিসেবে কাজ করছে।

সর্বশেষ খবর