মঙ্গলবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

গোপন প্রেম

মির্জা মেহেদী তমাল

গোপন প্রেম

ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙে আলাউদ্দিনের। বিরক্ত চেহারা নিয়ে বালিশের কাছে রাখা ফোনটি ধরে বলেন, ‘হ্যালো!’ ফোন রিসিভ করেন আলাউদ্দিন। ‘এই আমি!’ ওপাশে রুম্পার কণ্ঠ। আলাউদ্দিন হতবাক। কণ্ঠটা তার খুব পরিচিত। কিন্তু এত দিন পর! হ্যালো বলা ছাড়া আলাউদ্দিন কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না রুম্পার সঙ্গে। এত বছরের সম্পর্ক তাদের, সেদিন আলাউদ্দিনের মনে হচ্ছিল এই তো মাত্র কদিনের পরিচয়। বহুদিন ফোন করে বা ধরে ‘এই আমি’ কথাটি শোনেননি আলাউদ্দিন। অনেক দিন পর এমন কথা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। সে কথা ফোনে রুম্পাকেও বলছিলেন আলাউদ্দিন। ‘এই আজ দেখা করবা? আমার মনটা খুব খারাপ। ভালো লাগছে না। তোমার সঙ্গেও অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি এত দিন। তুমি আসবা? খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তোমাকে।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে যান রুম্পা। ‘আসব না মানে! কী বল এসব! এখন আসব?’ গদগদ হয়ে আলাউদ্দিন বলছিলেন রুম্পাকে। রুম্পা বলেন, ‘আরে না না। এখন না। সৈয়দপাড়ার শহীদনগর বাসার তিন তলায় চলে এসো। সন্ধ্যায়। দেরি করো না।’ ‘না, আমি সময়মতো চলে আসব’ বলেই ফোন রাখেন আলাউদ্দিন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র আলাউদ্দিন আলাওল। রুম্পা তার সাবেক প্রেমিকা। সকালে কথা বলেছেন তারা। আর সেই রাতেই লাশ হন আলাউদ্দিন। এ বছরের ২২ মার্চ রাতে চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানার পশ্চিম শহীদনগরের একটি বাসা থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। হাত-পা ছিল বাঁধা। প্রথমে অজ্ঞাত যুবক হিসেবে আলাউদ্দিনের লাশ উদ্ধার করা হলেও পরদিন মর্গে স্বজনরা শনাক্ত করেন। ওই বাসাটি ওমানপ্রবাসী আবু সৈয়দের। চার তলা ভবনের তৃতীয় তলার বাসার বাথরুম থেকে লাশ উদ্ধার হয়। তবে কে বা কারা কীভাবে তাকে খুন করেছে পুলিশ তখনো অন্ধকারে। পুলিশ খুনি গ্রেফতারে নামে মাঠে। তদন্ত শুরু হয়। কিন্তু বাসাটি খালি থাকায় কোনো কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। আলাউদ্দিনের মোবাইল ফোনের কললিস্ট বের করা হয়। পুলিশ দেখতে পায়, খুব সকালেই একটি নম্বরে কথা বলেছেন আলাউদ্দিন। আরও বেশ কয়েকটি ফোনেও কথা হয়েছিল। কিন্তু সকালে কথা বলা নম্বরটিকেই পুলিশ সন্দেহের তালিকায় নেয়। বেশ কিছু দিন আগে একই নম্বরে কথা বলার রেকর্ড খুঁজে পায় পুলিশ। পুলিশ জানতে পারে নম্বরটি রুম্পা নামের একজন মেয়ের। এ নামটি পাওয়ার পর পুলিশকে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি তার সম্পর্কে জানার জন্য। কিন্তু পুলিশের মাথায় ঢোকে না, কেন আলাউদ্দিনকে খুন করতে যাবেন রুম্পা। তারা তো একজন আরেকজনকে ভালোবাসতেন। কিন্তু পুলিশ যত গভীরে গেছে খুঁজে পেয়েছে এক গোপন প্রেমের গল্প। একসময় পুলিশ নিশ্চিত হয়, গোপন প্রেমের নৃশংস বলি হয়েছেন আলাউদ্দিন আলাওল (২৪)। প্রেম-পরকীয়া অতঃপর অভিসারের ফাঁদ পেতে খুন করা হয় আলাউদ্দিনকে। খুনি তারই সাবেক প্রেমিকা। সঙ্গে ছিলেন স্বামী, আর দুই দেবর। পুলিশের জালে আটকা পড়েছেন তারা। স্বীকার করে নিয়েছেন খুনের দায়। আলাউদ্দিনের মোবাইল রেকর্ডের সূত্র ধরে তার প্রেমিকা ইয়াসমিন আক্তার রুম্পাকে (২২) আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। একপর্যায়ে রুম্পা রোমহর্ষক এ হত্যার দায় স্বীকার করে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন। তার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রুম্পার স্বামী ইকবাল হোসেন (২৭), তার দুই সৎ ভাই মো. তৈয়ব (৩২) ও মো. হেলালকে (১৯) আটক করা হয়। রুম্পা পুলিশকে জানান, ‘আলাউদ্দিনের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ২০০৭ সালে। তখন আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। আমাদের প্রতিবেশী। একপর্যায়ে আমাকে প্রাইভেট পড়াতে শুরু করেন আলাউদ্দিন। পড়ার ফাঁকেই গড়ে ওঠে প্রেম। জীবনের প্রথম প্রেম। মন-প্রাণ উজাড় করে ওকে ভালোবাসতে শুরু করি। আমাকেও ও প্রচণ্ড ভালোবাসত। প্রেম গড়ায় বিছানা পর্যন্ত। আলাউদ্দিন এসব গোপনে ফ্রেমবন্দী করে রাখেন মোবাইলে। এরই মধ্যে ২০১০ সালে বিয়ে ঠিক হয়। হাটহাজারীর চৌধুরীহাটের ওমর সাদেকের সঙ্গে বিয়ে হয়।’ পুলিশ জানতে পারে, স্বামী যেমন তার প্রেমের কথা জানতেন না, তেমনি আলাওলের কাছেও বিয়ের কথা গোপন রাখেন রুম্পা। তাদের অভিসার চলতে থাকে আগের মতো। এমন লুকোচুরি চলে কয়েক বছর। পরে বিয়ের খবর জেনে যান আলাওল। আলাওল তাকে পালিয়ে যেতে বলেন সংসার ছেড়ে। তবে রুম্পা এতে সায় দেননি। স্বামীর সংসার আর পরকীয়ার নামে গোপন প্রেম চলতেই থাকে। তত দিনে রুম্পার কোলজুড়ে আসে কন্যাশিশু। একপর্যায়ে তাদের এই প্রেমের সম্পর্ক ধরা পড়ে স্বামী সাদেকের হাতে। ঘটনা বিস্তারিত জেনে রুম্পাকে তালাক দেন স্বামী। ২০১৬ সালের ২৫ জুলাই যেদিন সাদেক রুম্পাকে তালাক দেন সেদিনই ওমানপ্রবাসী রাউজানের ইকবাল হোসেনকে বিয়ে করেন রুম্পা। একপর্যায়ে আলাওলের নিষিদ্ধ প্রেম তাকে বিষিয়ে তোলে। এ কারণে ডিভোর্সের পরই ফের বিয়ে করেন রুম্পা। পালাতে চান আলাওলের খপ্পর থেকে। মুক্তি চান অভিশপ্ত সেই প্রেম থেকে। আবারও সবকিছু নতুন করে শুরু করতে চান। এবার স্বামী ইকবালকে নিয়ে নতুন জীবন, নতুন সংসার ভালোই চলছিল তার। কিন্তু দৃশ্যপটে আবারও সেই আলাওল চলে আসেন। এবার তিনি তার কাছে থাকা প্রেম আর অভিসারের ভিডিও বাজারে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেন এবং তাকে বাধ্য করেন আগের মতো তার আহ্বানে সাড়া দিতে। এভাবে চলতে চলতে একপর্যায়ে বিষয়টি ধরা পড়ে স্বামী ইকবালের কাছে। কিন্তু সবকিছুই অস্বীকার করেন রুম্পা। এরই মধ্যে স্বামী চলে যান ওমান। এ সময় তাদের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। অসুস্থ হয়ে হঠাৎ স্বামী ফিরে এলে তিনি সংযত হন। এড়িয়ে চলতে থাকেন আলাওলকে। কিন্তু আলাওল কোনো ধরনের বাধাই মানেন না। তার অব্যাহত হুমকি সঙ্গে স্বামীর সন্দেহাতুর চোখের পীড়াপীড়িতে একপর্যায়ে স্বামী ইকবালকে সব খুলে বলেন রুম্পা। স্বামী ইকবাল ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সিদ্ধান্ত নেন গোপন ও অভিশপ্ত এই প্রেমের গল্প শেষ করার। পরিকল্পনা করেন খুনের। তাই সেদিন সাতসকালে ফোন দেন আলাউদ্দিনকে। সন্ধ্যায় আলাউদ্দিন আসার পর তার হাত-পা বেঁধে গলায় দড়ি দিয়ে ফাঁস দেন স্বামী ইকবালসহ আরও কয়েকজন। সঙ্গে তো ছিলেনই রূম্পা। একসময় আলাউদ্দিনের জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। শেষ হয় অভিশপ্ত প্রেমের গল্প। কিন্তু তাকে হত্যা করে সুখে শান্তিতে থাকার যে পরিকল্পনা ছিল রুম্পার, তা আর হয়নি। খুন করার অপরাধে আটক হতে হয় তাকে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান সমাজে সর্বগ্রাসী নৈতিক অবক্ষয়ের বড় দৃষ্টান্ত এই খুনের ঘটনাটি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর