রবিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

স্থানীয় সরকার আইনে নেই সামঞ্জস্য

বিশেষজ্ঞরা বলছেন সব প্রতিষ্ঠানকে একই আইনের আওতায় নিয়ে আসা দরকার

নিজামুল হক বিপুল

ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে জেলা পরিষদ পর্যন্ত দেশের স্থানীয় সরকারগুলোর আইনে নানা অসঙ্গতি। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো একই আইনে দেশের পাঁচটি স্থানীয় সরকার পরিচালিত হলে এসব অসঙ্গতি থাকত না। কিন্তু স্থানীয় সরকারের প্রতিটি স্তরের জন্য পৃথক আইন থাকার কারণে এসব অসঙ্গতি বিদ্যমান। যার ফলে একের পর এক নির্বাচন করতে হয় স্থানীয় সরকারের প্রতিটি স্তরের জন্য। যদি স্থানীয় সরকারগুলো একই আইনের আওতায় চলত তাহলে একই তফসিলে সবকটি নির্বাচন একসঙ্গে করা যেত। এতে করে স্থানীয় সরকারের কার্যক্রমও বেগবান হতো। তাই বিশ্বের অন্যান্য দেশের, বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের স্থানীয় সরকার আইনগুলো পর্যালোচনা করে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে জেলা পরিষদ পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের যে পাঁচটি স্তর রয়েছে সেগুলোকে একই আইনের আওতায় নিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ভারতে একটি একক তফসিলে গ্রাম পঞ্চায়েত (জিপি), পঞ্চায়েত সমিতি (পিএস) ও জেলা পরিষদ (জেপি) এবং অন্য একটি পৃথক তফসিলে সব পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কারণ, সে দেশে একটি একক আইনে তিন স্তরের তিনটি প্রতিষ্ঠান গঠিত ও পরিচালিত হয়। তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক বিদ্যমান। তিনি বলেন, আমাদের দেশে প্রথম সমস্যা হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন কোনো একক আইনে নয়, সম্পূর্ণ পৃথক পাঁচটি আইনের মাধ্যমে গঠিত ও পরিচালিত। দ্বিতীয় সমস্যা আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর সাংগঠনিক কাঠামো। আমাদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থাৎ ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের আদলে গঠিত। এসব স্তরে প্রত্যেক ভোটার প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে তিনটি করে ভোট দেন। আবার জেলা পরিষদে সাধারণ ভোটারের ভোটাধিকার নেই। পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে জেলা পরিষদ গঠিত হয়।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর অংশগ্রহণমূলক, গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিমূলক ও প্রাণবন্ত করতে হলে প্রথমত রাষ্ট্রপতি আদলের সাংগঠনিক কাঠামোকে সংসদীয় পদ্ধতিতে রূপান্তর করা প্রয়োজন হবে; দ্বিতীয়ত, পাঁচটি পৃথক ও পরস্পর সম্পর্কবিহীন আইনের পরিবর্তে এক ও অভিন্ন একটি ফ্রেমওয়ার্ক আইনের মাধ্যমে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান গঠন ও পরিচালনা করতে হবে এবং তৃতীয়ত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সংসদীয় পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ দুটি পদ্ধতির মিশ্রণে একটি নতুন নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু করতে হবে। তাহলে স্থানীয় সরকারগুলোর প্রতিটি স্তরে যে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে তা সহজে দূর হয়ে যাবে।

তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা ও সিটি করপোরেশনগুলো প্রত্যেকটি পৃথক আইনে পারিচালিত। আইনগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন, অনেক ক্ষেত্রে পরস্পর সংঘাতপূর্ণ। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আন্তপ্রতিষ্ঠান সমন্বয় সহযোগিতা ব্যাহত হয়। পারস্পরিক উন্নয়ন সহযোগিতার কোনো স্বীকৃত কাঠামো নেই। কিন্তু একক আইনের আওতায় সবগুলো প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে এলে সব কাঠামোগত অসুবিধা দূর করা যাবে। তাই স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে হলে আইনগুলোর আমূল সংস্কার করে স্থানীয় সরকারের পাঁচটি স্তরকে একই আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ বিদ্যমান সব আইনকে সমন্বিত করে একটি মাত্র ‘লোকাল গভর্নমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক ল’ তৈরি করতে হবে।

উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও দুমকী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হারুন-অর রশীদ হাওলাদার মনে করেন, দেশের সব কটি স্থানীয় সরকারে কাঠামোগত ও ক্ষমতায় আইনি অসামঞ্জস্য দূর করা হলে স্থানীয় সরকার অনেকটা স্বশাসিত হবে, শক্তিশালী হবে। তিনি বলেন, দেশের কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত হয় সংসদীয় পদ্ধতিতে আর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা পরিচালিত হয় রাষ্ট্রপতি পদ্ধতিতে। এই কাঠামোগত ত্রুটিও দূর করা দরকার। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ায় স্থানীয় সরকারের এই বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর