রবিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিদেশে জিম্মি দেশে মুক্তিপণ

মির্জা মেহেদী তমাল

বিদেশে জিম্মি দেশে মুক্তিপণ

জমি বিক্রি আর ধারদেনা করে আদম বেপারির হাতে টাকা তুলে দেন কাইয়ুম। মালয়েশিয়া পাঠিয়ে তাকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আদম ব্যবসায়ী কবির আহমেদ। কিন্তু কাইয়ুমকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ লিবিয়ায়। লিবিয়ার বিমানবন্দরে নামার পরই এক ভয়ঙ্কর চক্রের হাতে বন্দী হন কাইয়ুম। এরপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। এরপর কাইয়ুমের পরিবারের কাছ থেকে কবির হাতিয়ে নেন সাড়ে ৪ লাখ টাকা। কিন্তু এ টাকায় খায়েশ না মেটায় কাইয়ুমকে মেরে ফেলার ভয় দেখানো হয়। অবশেষে বিষয়টি জানানো হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। ঢাকায় গ্রেফতার হয় কবির। এরপর ছেড়ে দেওয়া হয় কাইয়ুমকে।

শুধু কাইয়ুম নয়, স্বজনদের মুখে দুই মুঠো ভাত তুলে দিতে ভিটেমাটি বিক্রি করে পাচারকারীর মাধ্যমে বিদেশে গিয়ে শত শত যুবক বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন। লিবিয়াসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং বাংলাদেশ দূতাবাসে লোকস্বল্পতার কারণে বন্দীদের ফিরিয়ে আনতেও পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। এসব দেশ থেকে টাকা পাঠানোর উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় উপার্জনের টাকাও কেড়ে নিচ্ছে মানব পাচারকারী চক্র। এমন চক্রের অসংখ্য সদস্য ইতিমধ্যে গ্রেফতার হলেও বন্ধ হচ্ছে না মানবপাচারকারীর এমন ভয়ঙ্কর কাজ।  গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, দেশি-বিদেশি অর্ধশতাধিক চক্র স্বল্প আয়ের মানুষদের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে চাকরি দেওয়ার নামে মানব পাচার করছে। এসব চক্রের হাতে জিম্মি শত শত মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বনে-জঙ্গলে কিংবা বদ্ধ ঘরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। নির্যাতনের কারণে অনেকের মৃত্যু হচ্ছে। ভিটেমাটি বিক্রি করে বিদেশে যাওয়া এসব মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে যাচ্ছে জীবনও। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আদম পাচারকারীরা লিবিয়া, ইরাক, সুদান, উগান্ডা, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় পাচার করছেন। এসব দেশের বেশিরভাগই যুদ্ধবিধ্বস্ত হওয়ায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিষ্ক্রিয়। বাংলাদেশের দূতাবাসের লোকবল ও কাজকর্ম সীমিত হয়ে পড়ায় জিম্মিদের সহজে ফিরিয়েও আনতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অনেক ক্ষেত্রে তারা অভিযোগ পেয়েও ভুক্তভোগীদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে অসহায়।

জিম্মি থেকে কোনো মতে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা লোকজনও জানিয়েছেন, বিভিন্ন দেশে আদম পাচারকারীদের হাতে শত শত লোক বন্দী রয়েছেন। লিবিয়া থেকে ফিরে আসা এক যুবক জানান, তাকে লিবিয়ার একটি ছোট ঘরে প্রায় এক মাস বন্দী করে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আদম পাচারকারী সেলিম মাস্টারকে চাপ প্রয়োগ করায় তাকে ওই দেশের চক্র ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। লিবিয়ার সেই একই ঘরে আরও বন্দী আছেন। তারা সবাই বাংলাদেশি। পুলিশের অপরাধী তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এক কর্মকর্তা জানান, লিবিয়া, তুরস্ক, ইরাক, ইরান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বেশি জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি সিরিয়া ও সুদানেও এ ধরনের চক্র গড়ে উঠেছে। বৈধ কিংবা অবৈধভাবে দীর্ঘদিন ধরে একটি দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি স্থানীয় কিছু অপরাধীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। তাদের সহযোগিতায় দেশি-বিদেশি অপহরণকারী চক্র এ ধরনের অপরাধ করছে। আবার ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের অনেকেই অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ায় তাদের এ দুর্বলতার সুযোগ নেন অপহরণকারীরা। অপহৃত হওয়ার পর তাদের শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি ভয় দেখানো হয় পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার। তাই বাধ্য হয়েই তারা মেনে নেন অপহরণকারীদের দাবি। এসব ক্ষেত্রে দেশের পুলিশকেও কিছু জানানো হয় না। অন্যদিকে লিবিয়া ও ইরাকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে অস্থিতিশীল থাকায় সেখানেও এ বিষয়ে সফলতা পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল, সেসব দেশেই এসব চক্র বেশি সক্রিয়। তাই অবৈধ পন্থায় বিদেশ না যাওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।

সর্বশেষ খবর