সোমবার, ২১ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকেই দূতাবাসে হামলা

কুয়েতের ঘটনায় সব দূতাবাসে সতর্ক বার্তা সপ্তাহে ৭ দিনই বিশেষ কনস্যুলার সেবার নির্দেশ

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

দীর্ঘ দিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকেই কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসে হামলার ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বল্প বেতন ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়া প্রবাসী শ্রমজীবী বাংলাদেশিদের এই ক্ষোভের মূল কারণ আকামা পরিবর্তনের সুযোগ না পাওয়া। এ সুযোগ তৈরিতে ব্যর্থতা এবং বিভিন্ন সেবা নিতে দূতাবাসে এসে হয়রানি, বঞ্চনা ও অপমানের শিকার হওয়া থেকেই তাদের মধ্যে পুঞ্জীভূত হয় ক্ষোভ। গত বৃহস্পতিবার এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে বলে মনে করছেন কুয়েত প্রবাসী ও বাংলাদেশের সাবেক কয়েকজন কূটনীতিক। তবে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইতিমধ্যে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সব দূতাবাসে বিশেষ সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে। আলাদা নির্দেশনায় প্রয়োজনে সপ্তাহে সাত দিনই বিশেষ কনস্যুলার সেবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, হামলার ঘটনায় আটক দেড় শতাধিকসহ সন্দেহভাজন প্রায় দেড়শ, মোট তিন শতাধিক বাংলাদেশিকে নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। আটকদের কালো তালিকাভুক্ত করে সরাসরি বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শঙ্কা তৈরি হয়েছে সাধারণ প্রবাসীদের মধ্যেও। তবে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় দূতাবাসের পক্ষ থেকে আটক বাংলাদেশিদের মুক্তি দেওয়ার জন্য কুয়েত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। কুয়েতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালাম জানিয়েছেন, বাঙালিরা এক কাপড়ে দেশে ফেরত যাক এটা আমরা কোনো সময় কামনা করি না। কয়েক দিন আগেও ১৬ জনকে ফেরত পাঠাতে কুয়েত এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। দেনদরবার করে এয়ারপোর্ট থেকে তাদের আমরা ফেরত এনেছি। গত বৃহস্পতিবার যাদের আটক করা হয় আমরা তাদের ছাড়ানোর জন্য ইতিমধ্যে কুয়েত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। দূতাবাসের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি। এ বিষয়ে আমি কুয়েত পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা আমাকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, নিরীহ কোনো বাংলাদেশির বিরুদ্ধে তারা অ্যাকশনে যাবে না।

কুয়েতের গণমাধ্যমের খবর, দূতাবাসে হামলার ঘটনায় জড়িতদের ভিডিও ফুটেজ দেখে চিহ্নিত করেছে কুয়েতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ইতিমধ্যে এ হামলা ও ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িতদের নামে মামলা করেছে কুয়েতের তদন্তকারী সংস্থা। বৃহস্পতিবারই ঘটনাস্থল থেকে দেড়শজনকে আটক করা হয়। পরে কুয়েতের বিভিন্ন আইন-প্রয়োগকারী সংস্থা বাংলাদেশ দূতাবাসের তছনছ ও ভাঙচুরকৃত অংশ দেখে গেছেন। সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ নিয়ে গেছেন তদন্তকারীরা। এ ছাড়া সেদিন দূতাবাসের সামনে অবস্থান নেওয়া ৩০০ থেকে ৪০০ বাংলাদেশিকে শনাক্ত করা হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পাওয়া ভিডিও ফুটেজ থেকে। দূতাবাসের তরফ থেকে ভাঙচুরকৃত অংশগুলো মেরামত করা হচ্ছে।

জানা যায়, কুয়েতের লেসকো নামে একটি কোম্পানির বিরুদ্ধে গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা তিন মাসের বকেয়া মজুরি ও কাজ পরিবর্তনের অনুমতি না দেওয়ার অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার সকাল ৭টায় প্রায় ৩০০-৪০০ বাংলাদেশি শ্রমিক ও চাকরিজীবী দূতাবাসের সামনে সমবেত হয়ে ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে। এরপর সারা দিন দেনদরবার চলে। সকালে উপস্থিত শ্রমিকদের একটি গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা করে বকেয়া বেতন, কাজের অনুমতি নবায়নসহ তাদের তিনটি সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে ওই দিনই অপর এক বৈঠকে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ব্যবস্থাপকের (পরিচালনা) সঙ্গে আলোচনার পর আগামী ৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বকেয়া বেতন সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে লিখিত নেওয়া হয়। কিন্তু পরে ওই কোম্পানির প্রতিনিধি দূতাবাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে বাংলাদেশি কিছু শ্রমিক তাকে লাঞ্ছিত করেন। মারধরের শিকার হন দূতাবাসের কনস্যুলার (রাজনৈতিক) ও চ্যান্সেরি প্রধান মো. আনিসুজ্জামান এবং আরও দুজন ভিসা কর্মকর্তা। একপর্যায়ে কিছু শ্রমিক দূতাবাসের ভিতরে প্রবেশ করে আসবাসপত্রসহ বিভিন্ন সম্পদ ভাঙচুর ও তছনছ করেন। পরে দূতাবাসের অনুরোধের ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে আসে। স্পর্শকাতর স্থাপনার ক্ষতিসাধনের কারণে দেড়শতাধিক প্রবাসীকে গ্রেফতার করে কুয়েতের পুলিশ।

রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালামের মতে, প্রবাসীরা কেন এ ধরনের ঘটনায় লিপ্ত হলো তা আমাদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। কারণ যে কোম্পানিতে বাংলাদেশি ওই শ্রমিকরা কর্মরত ছিলেন, তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। বিষয়টি সুন্দর সমাধানও হয়েছিল। কোম্পানি লেসকো আন্ডারটেকিং দিয়েছিল। তারা ৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বেতন ও বকেয়া পরিশোধ করবে। পাশাপাশি আকামা পুনরায় নবায়নের বিষয়েও সম্মত হয়েছিল। তবে আকামা পরিবর্তনের সুবিধা না থাকায় ক্ষুব্ধ হয়ে তারা এই কা  ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে আমরা ধারণা করছি।

তবে দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচি পালনের সময় ফেসবুক লাইভে প্রবাসীরা বলেন, সাত থেকে আট লাখ টাকা খরচ করে কুয়েতে এসেও ভালো নেই আমরা। লেসকো কোম্পানির জালিয়াতি সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের বসবাসের ব্যারাকে পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই। খাবার নেই। হযরত আলী নামে এক বাংলাদেশি নিজের দুর্দশার কথা তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস আমাদের ঘাড় ধাক্কা মেরে বাইরে ফেলে দিচ্ছে। সবার তরফ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সংকট সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়ে প্রবাসী ওই কর্মী বলেন, আমাদের সুব্যবস্থা করবেন। না হলে আত্মহত্যা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় থাকবে না। সেদিন উপস্থিতি বিক্ষুব্ধ প্রবাসী কর্মীরা দূতাবাসের সামনেই উচ্চৈঃস্বরে দূতাবাসের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। সেটা ফেসবুকে লাইভ সম্প্রচারিতও হয়।

সর্বশেষ খবর