তারিকুল ইসলাম লিটন। বয়স ৪০। বছর বিশেক আগে বরগুনার গৌরিচন্না গ্রামের এই তারিকুল কাজের সন্ধানে ঢাকা আসেন। গুলশান-২ নম্বরে ডিসিসি মার্কেটের একটি অ্যান্টিক শপে কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ৮ বছর কাজ করার পর একই মার্কেটে নিজেই একটি অ্যান্টিক হ্যান্ডিক্রাফটের দোকান খুলে বসেন। এই ব্যবসাটা তিনি খুব তাড়াতাড়ি রপ্ত করেছেন। কোথা থেকে কী হয়, কোথা থেকে মহামূল্যবান সামগ্রী বিভিন্ন হাত গলিয়ে দোকান পর্যন্ত আসে, সবই তার জানা। অ্যান্টিক শপের আড়ালে দেশের মহামূলবান প্রত্নসম্পদ পাচারের লাইনঘাটও জানা হয়ে গেছে।
সম্প্রতি রাজধানীর ভাটারা থানার নর্দার শহীদ আবদুল আজীজ সড়কের একটি বাসা (নম্বর ক-২৭) থেকে বিপুল পরিমাণ প্রত্নসম্পদ উদ্ধারসহ লিটনের ভাই মনিরুলকে (৩৬) গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। প্রত্নসম্পদের মধ্যে রয়েছে ১০টি বিভিন্ন ধরনের কষ্টি ও বেলে পাথরের মূর্তি, ১৮টি বিভিন্ন ধরনের ধাতব মুদ্রা, একটি প্রাচীন তাম্রলিপি এবং কয়েকটি বিভিন্ন ধরনের অতি প্রাচীন স্মারক। মনিরুলের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে তার ভাই লিটনের প্রত্নসম্পদ পাচারের খবর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নীরবে নিভৃতে তিনি বনে গেছেন বিত্ত-বৈভবের মালিক। তিনি যেন এক আড়ালের কোটিপতি। শুধু লিটন নয়, দেশের মহামূল্যবান প্রত্নসম্পদ পাচারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্রের যোগসাজশ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দীর্ঘদিন ধরে এ চক্রের সদস্যরা প্রত্নসম্পদ পাচার করে আসছে। দেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে তারা মূল্যবান প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ করে গোপনে পাচার করছে বিদেশে। প্রত্নসম্পদ উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্বদানকারী ডিবির কর্মকর্তারা জানান, চক্রটি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রত্নসম্পদ সংগ্রহের পর তা ঢাকায় সংরক্ষণ করে। পরে আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি চক্রের সদস্যরা ঢাকায় এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এসব প্রত্নসম্পদের মূল্য নির্ধারণ করেন। সেখান থেকে অতি মূল্যবান এসব প্রত্ননিদর্শন চলে যায় বিদেশে। প্রত্নসম্পদের চালানটি ধরা পড়ার দুই দিন পর রাজধানী থেকে পাচারের আগে প্রত্নসম্পদের আরেকটি চালান জব্দ করেছে র্যাব। চালানটিতে উদ্ধার হয় কষ্টি পাথরের মূর্তি। এ ছাড়াও সদরঘাট থেকে আরেকটি কষ্টি পাথরের মূর্তি পাচারকালে উদ্ধার করেন পুলিশ। ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোং ১৮০৮’ লেখা কষ্টি পাথরের মূর্তিটি পাচারকালে গ্রেফতার হন বুয়েট থেকে পাস করা এক প্রকৌশলী। তার বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় পুরাকীর্তি আইনে একটি মামলাও হয়েছে। যদিও মাত্র ১৮ দিন কারাবাসের পর জামিনে মুক্তি পান তিনি। তার কাছ থেকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, কষ্টি পাথরের মূর্তিটি বরগুনার এক কৃষক মাটি কাটার সময় উদ্ধার করেন। পরে এটি ৫০ লাখ টাকা চুক্তিতে কিনে আনেন তিনি। জামান নামের এক ব্যক্তির কাছে প্রত্নসম্পদটি ১ কোটি টাকায় বিক্রি করতে চুক্তিবদ্ধও হন। সেই চুক্তি মোতাবেক তিনি কষ্টি পাথরের মূর্তিটি ঢাকায় নিয়ে আসেন। র্যাবের পরিসংখ্যান বলছে, গত এক যুগে প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণে তিন শতাধিক অভিযান পরিচালনা করেছে র্যাব। এসব অভিযানে পাচারের সময় উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় দেড় হাজার প্রত্ননিদর্শন। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ৪৮৬টি মূর্তি ও ৮১১টি মূর্তির ভগ্নাংশ। পরে উদ্ধার হওয়া প্রত্নসম্পদগুলো সংশ্লিষ্ট অধিদফতরে জমা দেয় র্যাব। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশকিছু মূল্যবান প্রত্নসম্পদ রয়েছে। এসব সম্পদ চুরি করার জন্য বেশ সক্রিয় কিছু দেশি-বিদেশি চক্র। চক্রগুলো দীর্ঘদিন ধরে পরস্পর যোগসাজশে কষ্টি পাথরের তৈরি মূর্তি ও মূল্যবান দ্রব্য অবৈধভাবে পাচার করে আসছে। তবে এর মধ্যে কিছু চক্র আছে, যারা পুরনো কয়েন থেকে শুরু করে নানা ধরনের সামগ্রী অধিক মূল্যে বিক্রির প্রলোভন দেখিয়ে অনেকের সঙ্গে প্রতারণা করে থাকে। তাদের বিরুদ্ধেও নজরদারি রয়েছে র্যাবের। সূত্র জানায়, চুরি হওয়া প্রত্নসম্পদের অধিকাংশই বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বিদেশে পাচার হয়ে থাকে। বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পাচারকালে বেশকিছু প্রত্নসম্পদ উদ্ধার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর সূত্র জানায়, গোয়েন্দা পুলিশের উদ্ধার করা অধিকাংশ প্রত্ননিদর্শনগুলো আসল। এগুলো মহামূল্যবান। বাংলাদেশ অনেক সমৃদ্ধ একটা দেশ। এখানে বিভিন্ন জনপদে মূল্যবান অনেক প্রত্নসম্পদ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। দেশি কিছু রাঘববোয়ালের সহায়তায় আন্তর্জাতিক চক্রের সদস্যরা এসব প্রত্নসম্পদ পাচার করছে। এসব অতিমূল্যবান প্রত্নসম্পদ রক্ষায় সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও শক্ত ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মাঝেও সচেতনতা তৈরি করতে হবে। প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিদফতরের নিজস্ব কোনো ইন্টেলিজেন্স নেই। যদি এনবিআর, দুদকসহ অন্যান্য সংস্থার মতো নিজস্ব ইন্টেলিজেন্স টিম থাকত, সেক্ষেত্রে প্রত্নসম্পদ রক্ষায় নিয়মিত নজরদারি করা যেত। এখন কেবল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রত্নসম্পদগুলো যথাযথ নিয়মে সংরক্ষণের কাজটি করে থাকে অধিদফতর। পাশাপাশি যদি কখনো প্রত্ননিদর্শন পাচারের কোনো তথ্য পায়, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়ে থাকে।