শনিবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

নিখোঁজ শিশু যায় কোথায়

মির্জা মেহেদী তমাল

নিখোঁজ শিশু যায় কোথায়

তেজগাঁও বেগুনবাড়ির ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন। স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তার ছোট্ট সংসার। বাসার সামনেই তার ভাঙাড়ি দোকান। ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ফারুক তার ছেলে সজীবকে মশার কয়েল কিনে আনতে দোকানে পাঠান। মশার কয়েল কিনতে গিয়ে খবর নেই সজীবের। তার খোঁজে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই নেমে যান রাস্তায়। কিন্তু নেই সজীব। কোথাও তাকে পাওয়া যায় না। রাতেই তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন তার বাবা। সপ্তাহ গেল, মাস গেল, পেরিয়ে গেল বছর। ছেলেকে হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে মা-বাবার। হতাশ আত্মীয়স্বজনরাও হাঁপিয়ে উঠলেন। সিনিয়র পুলিশ অফিসারদের কাছে সজীবকে খুঁজে না পাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে করতে হাঁপিয়ে উঠলেন এসআই তৌহিদ। একপর্যায়ে নিখোঁজ সজীবকে প্রায় ভুলেই গেলেন সবাই। কিন্তু পুলিশ ঠিকই তার খোঁজ করে নানাভাবে। শুধু ভুলতে পারল না পুলিশ। প্রাত্যহিক কাজের মধ্যেই পত্র-পত্রিকা, ফেসবুকে নিয়মিত সজীবকে খুঁজে ফেরেন এসআই তৌহিদ। প্রতীক্ষায় থাকেন একটা ফোনকলের। ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর। তেজগাঁও বিভাগের এডিসি হাফিজ আল ফারুক, এসি সালমান হাসান ও আরও কয়েকজন তদন্তাধীন মামলার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আলোচনার ফাঁকে এসি সালমান হাসানের চোখ আটকে যায় একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে। রেললাইনের প্ল্যাটফরমের পাশে ভিক্ষার থালা হাতে বসে আছে এমন একজনের অস্পষ্ট ছবির পোস্ট। একজন স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘ছেলেটার বাপ মা কই আল্লাহ জানেন। খুব কষ্টে আছে সে।’ সজীবের মা-বাবাকে ডেকে আনলেন এসআই তৌহিদ। রেললাইনের প্ল্যাটফরমের পাশে ভিক্ষার থালা নিয়ে বসে থাকা যে ছেলেটির ছবি ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে, তাকে সজীব বলে শনাক্ত করলেন তার বাবা-মা। কাশেম মিয়া নামের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়া সেই ব্যক্তির সঙ্গে ফেসবুকে যোগাযোগ করলেন এসি সালমান হাসান। সজীবের ছবি তুলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছিল সেটা কোন জায়গা ছিল জানতে চাওয়া হলো তার কাছে। এড়িয়ে গেলেন লোকটি। ডিঅ্যাকটিভেট করে দিলেন নিজের অ্যাকাউন্ট। প্রায় দুই বছর পর ছেলেকে ফিরে পাওয়ার যে স্বপ্ন দেখছিলেন মা-বাবা, নিমেষেই ভেঙে গেল। এসি সালমান হাসান এসআই তৌহিদকে পাঠালেন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টারের কাছে। ছবি দেখে স্টেশন মাস্টার জানালেন, ‘এটি জামালপুর রেলওয়ে স্টেশনের ছবি।’ পুলিশ গেল সেখানে। রাসেল নামে ১০-১১ বছর বয়সী একটি ছেলে এসআই তৌহিদ ও এসআই নজরুলকে জামালপুর শহরের সরকারি জাহেদা শফির মহিলা কলেজ গেট এলাকায় পুরাতন কাগজ ক্রেতা সালাম মোল্লার কাছে নিয়ে গেল। সালাম মোল্লা সজীবের ছবি দেখে চিনতে পারেন। সালাম মোল্লা জানান, কাগজ আলী নামের একজন কুড়ানো ও পুরাতন কাগজপত্র বিক্রি করে তার দোকানে। মাসখানেক আগে সজীবও তার সঙ্গে আসত। বেশ কিছুদিন থেকে কাগজ আলীকে আর দেখা যাচ্ছে না এলাকায়। কাগজ আলী মূলত রেলওয়ে স্টেশনে যারা কাগজ কুড়ায়, তাদের কাছ থেকে কুড়ানো কাগজপত্র কিনে সালাম মোল্লার দোকানে বিক্রি করতেন। সালাম মোল্লা অনেক কাগজপত্র ঘেঁটে কাগজ আলীর মোবাইল নম্বর দেন এসআই তৌহিদকে। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় কাগজ আলীর ব্যবহৃত মোবাইলের অবস্থান পাওয়া যায় গাজীপুরের এরশাদনগর বস্তি এলাকায়।

তৎক্ষণাৎ এসআই তৌহিদ ও এসআই নজরুল তাদের টিম নিয়ে চলে যান গাজীপুর এরশাদনগর বস্তি এলাকায়। এসআই নজরুল নিজেকে পুরাতন কাগজ ক্রেতা হিসেবে পরিচয় দিয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলেন কাগজ আলীর সঙ্গে। তার কাছেই পাওয়া যায় সজীবকে। তিনি জানান, সজীবকে তিনি পেয়েছেন জামালপুরে। ভিক্ষা করত সেখানে। কেউ একজন বসিয়ে রেখে যেত।

পুলিশ জানায়, মশার কয়েল কেনার জন্য বাসা থেকে বের হওয়ার পর কেউ একজন সজীবকে কম দামে বেশি কয়েল দেওয়ার কথা বলে অন্যদিকে নিয়ে যায়। আর কিছু বলতে পারে না সে। তবে ভিক্ষাবৃত্তির জন্য তাকে অপহরণ করা হয়েছিল বলে পুলিশ ধারণা করছে। সেই চক্রকে খোঁজা হচ্ছে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর