রবিবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঘৃণা এড়াতে চায় ওরা

মাহবুব মমতাজী

ঘৃণা এড়াতে চায় ওরা

বাব-দাদা করেছে এই কাজ। তাদের বাপ-দাদাও করত। বংশের পর বংশ করেছে। তাই, আমরাও করছি। কিন্তু আমরা চাই না ‘আমাদের সন্তানরা আমাদের মতো হোক।’- আক্ষেপ করে এমন কথাই বলছিলেন রতন। তার পদের নাম ‘মর্গ সহকারী।’ চাকরি করেন রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। কাগজে-কলমে যারা মর্গ সহকারী তাদের মূল কাজ লাশ কাটা-ছেঁড়া। সমাজ এদের বলে ‘ডোম।’ লাশ কাটা-ছেঁড়া করে বলে সমাজে তাদের ঘৃণার চোখে দেখা হয়। বংশগত পেশা পরিত্যাগ করা খুবই কঠিন। তাই ঘৃণ্য না থাকার উদ্দেশ্যে এদের কেউ কেউ ধর্মত্যাগ করে মুসলমান হয়েছেন। কারণ অন্য পেশা বা ধর্মের কোনো সন্তান মিশতে চায় না তাদের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে। ফলে একঘরে হয়ে থাকতে হয় এদের। মেডিকেল কলেজের এনাটমি বিভাগে লাশ থেকে কঙ্কাল বের করা এবং ময়নাতদন্তের সময় লাশ কাঁটা তাদের পেশা। অবৈধ কোনো কাজ করেন না তারা। তবুও সমাজে ডোমদের অস্পৃশ্য জ্ঞান করা হয়। এ অবস্থায় পেশাগত নিরাপত্তা, আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের এ কাজে দক্ষ করে তোলার দাবি জানান ডোমেরা। তারা স্বীকৃতি চান মানুষের, মর্যাদা চান সমাজে। প্রায় দুই যুগ ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে লাশ কাটার কাজ করে আসছেন সেকেন্দার আলী। তিনি আগে ছিলেন হিন্দু। নাম ছিল ‘সেকেন্ড’। বংশ পরম্পরায় ডোম হয়েছেন। বছর পাঁচেক আগে তিনি নিজের এবং সন্তানের সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবে মুসলমান হয়েছেন। বছর দেড়েক আগে তার ছোট ভাই গেসোও মুসলমান হয়ে বাবুল নাম ধারণ করেন। তাদের আরও দুই ভাই রাজা ও রামু এখনো স্বধর্মেই রয়েছেন। মর্গ সহকারী পদধারীদের সরকারি বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। অন্য ডোমরা লাশের স্বজনদের কাছ থেকে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা বকশিশ পেয়ে সংসার চালান। ধর্ম পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে কয়েকজন জানালেন, এক সময় ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে ডোম কাজ করত। কিন্তু এদের অনেককেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ডিসিসির শ্মশানঘাটে এখন কয়েকজন ডোম কাজ করেন। বেশির ভাগ ডোমই বেকার। সামাজিক কারণেও অনেকে ডোম সম্প্রদায়ের লোকদের কাজ দিতে চান না। তাই সামাজে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার জন্য পরিচয় পরিবর্তন করছেন। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গ সহকারী শ্যামল জানান, তার বাবা রমেশ ডোম ছিলেন। বাবার সূত্র ধরে তিনিও ডোম হয়েছেন, হাজার লাশ কাটার অভিজ্ঞতা তার। ‘ডোমের কাজ করি’ বললে অনেকে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখেন। কিন্তু আমাদেরও তো জীবন আছে, সংসার আছে। সরকারিভাবে বেতন-ভাতাতে আমাদের ব্যক্তিগত জীবন ভালোভাবেই কেটে যায়। ডোমরা ভারতের বিহার ও অন্ধপ্রদেশ থেকে বাংলাদেশে আসেন ১৮৩৫ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে। আবার ১৬২৫ থেকে ১৬২৮ সালের মধ্যেও অনেকে এসেছেন। ২০০১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায়, দেশে ডোম ৩ লাখ ১৭ হাজার ৩৩৭ জন। ধর্ম বদলের সুবাদে বর্তমানে বেশকিছু মুসলমানও দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে আছেন লাশকাটা পেশায়। ডোমদের অনেকেই আবার দলিত সম্প্রদায়ের। ডোমেরা সাধারণত শ্রাবণী পূজা করেন। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গ সহকারী রতন তার পিতার পর ১৯৯৪ সালে এ কাজ নেন। তিনি জানান, অন্যরা এ কাজ ভালোভাবে করতে পারেন না বলে মর্গগুলোতে ডোম সম্প্রদায় থেকে লোক নিয়োগ দেওয়া হয়। শুরুতে লাশ কাটার সময় অনেক খারাপ লাগত। কোনো শিশু কিংবা নারীর পেটে যখন ছুরি চালাতে হতো তখন ভয় লাগত। রতন বলেন, আমরা লাশের হিসাব-নিকাশ করে লাশ কাটি। আমাদের দিয়ে এনাটমি বিভাগে প্রাকটিক্যাল ক্লাস হয়। তিনি দুঃখের সঙ্গে জানান, মানুষ আমাদের ঘৃণা করে। কিন্তু আমরা উপকার ছাড়া কারও অপকার করি না। ঢামেক মর্গের একজন জানান, সকাল হলেও লাশ দেখি। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগেও লাশ দেখি। এমনও হয়েছে ২৪ ঘণ্টাই লাশের সঙ্গে কাটিয়েছি। কিন্তু এ কাজ করে সমাজে পরিচয় দিতে পারি না। এক সময় হাতুড়ি দিয়ে ময়নাতদন্ত হয়েছে। এখন ঢামেক মর্গ ডিজিটাল। বিভিন্ন ধরনের আধুনিক মেশিন আছে। তার বিশ্বাস ধীরে ধীরে এই পেশাও ডিজিটালি আধুনিক হয়ে ওঠবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর