বুধবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

লোহা পিটিয়ে জীবিকা

মাহবুব মমতাজী

লোহা পিটিয়ে জীবিকা

বড় সব হাট-বাজারে কামারশালা থাকবেই। ব্যতিক্রম নয় রাজধানীর কারওয়ান বাজারও। এখানে কর্মকাররা ঐতিহ্যবাহী লাল থাকতে আঘাত হানার ব্যবসা করে চলেছেন। ইংরেজিতে বলা হয় ‘হিট দ্য আয়রন, হোয়েন ইট ইজ রেড’ (লোহা লাল থাকতে আঘাত হানো, তাহলে তাকে নতুন রূপ দিতে পারবে)। কর্মকাররা ওই কাজই করেন। আগুনে লোহা পুড়িয়ে লাল করেন। তখন ওটা একটু নরম হয়। এরপর পিটিয়ে তাকে বঁটি, খুন্তি, পাছুন, কৃষকের কাস্তে, নিড়ানি, কোদাল, লাঙলের ফলা, শ্রমিকের কুঠার, শাবল, দা এবং  ছোট-বড় চাকু ইত্যাদি বানিয়ে থাকেন। কেনাকাটা করতে বাজারে আসা মানুষের কোলাহলের মাঝখানেই ছোট্ট একটি টিনের চালার ঘর। তিন দিকে ফাঁকা। কামারখানার ‘বাণিজ্যিক চিহ্ন’ হাপর। শক্ত চামড়া ত্রিকোণ করে নির্দিষ্ট মাপে কয়েকটি ভাঁজে তৈরি হাপরের নিচে পাইপ বসিয়ে তা মাটির ভিতরে রেখে টেনে নেওয়া হয়েছে প্রায় ফুট দূরে। হাপরের দুই ধারে বাঁশের সঙ্গে যুক্ত লম্বা ছোট বাঁশ। যা সামনের দিকে টেনে আনা। সেখান থেকে লিভার টেনে হাপরের বাতাস মাটি খুঁড়ে বানানো ছোট্ট চুলাতে দিচ্ছেন সুবল কর্মকার। মাঝে মাঝে কাঠকয়লাও দিচ্ছেন চুলাতে। ছোট্ট একটি সেই লোহা আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে রক্তলাল রঙ করে বড় হাম্বল দিয়ে পিটানো শুরু হলো। পেটাতে থাকেন সুবলের সহকারী দুই কর্মকার মঙ্গল আর বলয়। মিনিট দশেক পেটাতে পেটাতে বানানো হলো ছোট একটি ছেনি। টেম্পার (শক্তিমান) বেশি রাখতে পানির ভিতর ধীরগতিতে চুবিয়ে হালকাভাবে শীতল করা হয় তা। এরপর ফিনিশিং। এই হলো কামারপাড়ার নিত্যদিনের কর্ম। শরীয়তপুর সদরে জন্ম সুবল কর্মকারের। দাদা ছিলেন কামার। বাবাও করেছেন একই কাজ। তার কাছে কাজ শিখে ১৯৭২ সালে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। কারওয়ান বাজারে মাসিক ২৫ টাকায় ঘর ভাড়া নিয়ে চালু করলেন দা, বঁটিসহ লোহার নানা জিনিসপত্র বানানোর কামারখানা।

এ প্রতিবেদককে সুবল জানান, চার পুরুষের ব্যবসা তাদের। কামারখানার ব্যবসাটা জমজমাট ছিল এরশাদের শাসনামল পর্যন্ত। এখন আর সেই দিন নাই। নানা ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি এসে যাওয়ায় তাদের কদর কমে গেছে। তাদের জিনিস বানানোর প্রধান উপকরণ লোহা আর কয়লা। লোহা ধোলাইপাড় কিংবা নয়াবাজার থেকে ৬০-৭০ টাকা কেজি দরে কিনে আনেন। আর ইটভাটায় উচ্ছিষ্ট হিসেবে থাকা কয়লা ধুয়ে শুকিয়ে ১৬শ টাকা বস্তা হিসেবে আনা হয়। তিনি জানান, গৃহস্থালির মাঝারি বঁটি, দা, খন্তিসহ ছোট ছোট অনেক জিনিস বানানো হয়। তাদের পরম্পরায় এই ব্যবসা ‘শুধু কামারদের’ নেই; নানা জাতের মানুষের খাই মেটাতে গিয়ে ব্যবসাটা এখন বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে। সুবলের আর আগের মতো দিন চলে না। ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ। কোরবানি এলে একটু বিক্রি বাড়ে। বর্তমানে দিনে দেড় দুই হাজার টাকার বিক্রি হয়। এর মধ্যে আবার তিন বেলা খাওয়া দিয়ে দুই সহযোগীকে সাড়ে ৫শ টাকা করে হাজিরা দিতে হয়। কথা হয় কামার ব্যবসায় জড়িত ইউসুফ নামে আরেকজনের সঙ্গে। তার বাড়ি নড়াইলে। জানালেন, ছোটবেলায় কামারের দোকানে কাজ করতেন। সেই সুবাদে এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। তার মতে, আগামীতেও টিকে থাকবে এই শিল্প। কারণ প্রতিটি ঘরেই কামারের তৈরি গৃহস্থালি ‘মাল’ দরকার। যাদের এই মাল আছে, তাদেরও মেরামতি। মেরামতি কি কামার ছাড়া সম্ভব। জানা গেছে, অতীতে কামার শিল্প ছিল রাজাদের নিয়ন্ত্রণে। কামারশালায় রাজ্য ও রাজপ্রাসাদ রক্ষায় অস্ত্র বানানো হতো। পিছিয়েপড়া মানুষরাই জড়িত ছিল এ কাজে। ১৩৫০ সালের দিকে মিসরে কামারশিল্প সম্প্রসারিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মিসর স¤্রাজ্ঞীর সর্বশেষ সপ্তম ক্লিওপেট্রা এবং রোমান স¤্রাট জুলিয়াস সিজার কামারশালাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যান। বিশ্ব সভ্যতার আগমনে কামার শিল্প থেকেই উত্তরণ ঘটে ফাউন্ড্রি এবং লোহার ভারী শিল্পের। তারপর যন্ত্রযুগে পৃথিবীর এগিয়ে চলা। যদিও আধুনিক যুগে লেদ মেশিনে অনেক কিছুই তৈরি হচ্ছে। তারপরও লৌহজাত অনেক কিছু কামাররাই তৈরি করেন। এর মধ্যে রয়েছে- বঁটি, খুন্তি, পাছুন, কৃষকের কাস্তে, নিড়ানি, কোদাল, লাঙলের ফলা, শ্রমিকের কুঠার, শাবল, দা এবং ছোট-বড় চাকু। এ ছাড়া আদিবাসী সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার জন্য বর্শা, ধনুকসহ নানা কিছু তৈরি হয় কর্মকারের হাতে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর