বৃহস্পতিবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

চোখে চোখে পথিকের পা

মাহবুব মমতাজী

চোখে চোখে পথিকের পা

সমাজের অন্যরা যখন মাথা উঁচু করে চালিয়ে যায় নানারকম পেশা, তখন তাদের নজর আটকে থাকে পথিকের পায়ের দিকে। ফুটপাথ ধরে যারা হেঁটে যায় তাদের পায়ের জুতা বা স্যান্ডেল যদি হয় রংজ্বলা, ঘষটানোর দাগ-লাগা, ছেঁড়া তখন তারা আশাবাদী হয়ে ওঠে। কাস্টমার বলবে ‘সারাই করে দাও। রং করে দাও। ঝকঝকে করে দাও।’ তারাও হাঁকে ‘পালিশ করাইয়া লন স্যার/আসেন ম্যাডাম, জুতাটা নতুন কইরা দিমু।’ কোনো কোনো সময় সন্তানরা এদের ‘সেবা’ গ্রহণের জন্য দিওয়ানা হতেও দেখা যায়। হিন্দুধর্মের ঋষি সম্প্রদায়ভুক্ত এরা। তবে ‘রবিদাস’ বা ‘চামার’ কিংবা ‘মুচি’ নামেও পরিচিতি রয়েছে। এমন একজনের নাম বিজয়, তিনি ঋষি সম্প্রদায়ের। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলের সামনে ফুটপাথে জুতা-স্যান্ডেল সেলাই-পালিশের ছোট্ট একটি দোকান তার। বিজয় জানান, মুচি বলে অন্যরা তাদের ঘৃণা করে। মর্মান্তিক হলো, মুচি বা চামাররা হিন্দুধর্মাবলম্বী হলেও হিন্দুরাও মুচিদের অস্পৃশ্য মনে করে। তারা কোনো দোকানে একসঙ্গে বসে চা খেতে পারেন না। তাদের সঙ্গে করে আলাদা কাপ রাখতে হয়। যারা তাদের চেনেন তাদের কাছে চায়ের কাপ নিয়ে গেলে অন্য কাপে চা বানিয়ে উঁচু করে ঢেলে দেওয়া হয়। তখন অনেক লজ্জা হয়। মনে হয় মুচির ঘরে জন্ম নেওয়াই অপরাধ। তাদের সঙ্গে কেউ সহজে মেয়ে বিয়ে দিতেও চায় না। লোকে তাদের ‘ঋষি’ নামের বদলে ‘মুচি’ বলে।

শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট থেকে বঙ্গবাজার পর্যন্ত সড়কে জুতা কালি করার দোকান মাত্র একটি। ব্যস্ত পথচারীদের পায়ে বিজয়ের নজর থাকে সমান্তরালে। ওই পথে কারও স্যান্ডেলটা হয়তো পটাং করে ছিঁড়ে গেল কিংবা তড়িঘড়ি বেরোতে গিয়ে জুতায় কালি দিয়ে ঝকঝকে করা হলো না, কিংবা টানতে গিয়ে ব্যাগের চেইনটা কট করে আটকে গেল, তখন উপায় কী! বিজয়দের মতো ঋষিদের কারও একজনকে পাওয়ার জন্য উদ্বিগ্ন চোখে এদিক-সেদিক তাকাতে হয়। কারণ বিজয়রাই তখন ভরসা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গ্রামের বাড়িতে তিন ছেলেমেয়েসহ ছাপরার মতো দুটি ঘরে বাঁধা বিজয়ের সংসার। বয়স এখন তার ৫০ ছুঁইছুঁই। ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করে। দিনে কখনো ২০০, কখনো ৫০০ টাকা- এমন আয়রোজগার থাকে। ঢাকায় ছোটখাটো মেসে থাকেন তিনি। মাস শেষে বাড়িতে পাঠাতে হয় ৭-৮ হাজার টাকা। আলাপের একপর্যায়ে বললেন, ১৯৭৯ সালের দিকে তার এলাকার হরিশ নামে একজন এ কাজ করতেন। অল্প বয়সে বাবা মারা যান। মা বেঁচে ছিলেন। অভাবের সংসারে হরিশের মাধ্যমেই তার মুচির কাজে যোগ দেওয়া। জুতা পালিশ করার কালি, ব্রাশ, ক্রিম ইত্যাদি পুরান ঢাকার বংশাল থেকে কিনে এনে কাঠের বাক্স নিয়ে দোকান দিয়ে বসেন। ২০-৩০ বছর আগে জুতা পালিশের অনেক আয় হতো। এখন তেমনটা নেই। শুরুর দিকে বসতে হতো বিদ্যুতের খাম্বার গোড়ায় অনেকটা বাধ্য হয়ে। তখন কোনো না কোনোভাবে প্রায় সারা দিনই রোদের হালকা তাপ লাগত গায়ে। এভাবেই কাজ করে দিন চলত। তবে এ কাজে সবাই বংশগতভাবে জড়িয়ে পড়ে। তার অভিযোগ, ঋষিদের কাজ কোনোকালেই তেমন মর্যাদা পায়নি। এমনকি উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কাছেও নানানভাবে উপেক্ষিত হয়ে আসছেন তারা। সমাজের গ্লানি, অশ্রদ্ধা, দরিদ্রতার কারণে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে ঋষিদের জীবনেও। বাপ-দাদাদের আদত পেশা থেকে ক্রমেই সরে দাঁড়াচ্ছেন তারা। জানা যায়, রবিদাসদের নামকরণ হয় তাদের আদি ধর্মগুরু সন্ত রবিদাসজির নামে। পরে ১৮৭২ সালের আদমশুমারিতে তাদের চামার বা মুচি হিসেবে উল্লেখ করে ফেলা হয় আধা-হিন্দু উপজাতির পর্যায়ে। আবার রবিদাসদেরই আগে বিকৃতভাবে মুচি বা চামার নামে ডাকা হতো। চামড়ার কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে এদের চর্মশিল্পী, চর্মকার (চামার), মুচি নামে অভিহিত করা হলেও রবিদাসরা চামার বা মুচি শব্দটিকে অত্যন্ত অসম্মানজনক মনে করেন। ১৯৬২ সালের ভূমি জরিপে মুচিদের ‘ঋষি’ বলে তালিকাভুক্ত করা হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর