শুক্রবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাঁচার নামে আছি মরে

মাহবুব মমতাজী

বাঁচার নামে আছি মরে

কালের বিবর্তনে দেশ নয় মৃৎশিল্পীদের জীবনমান অবনত হয়েছে। সাধারণ্যে কুমার নামের এই শিল্পীরা আজকাল কেমন আছেন? প্রদীপ কুমার পাল বললেন, আমরা মৃৎশিল্পীরা বেঁচে আছি কোনো মতে। বলা উচিত বাঁচার নামে আছি মরে।’ তাচ্ছিল্য আর অবহেলার শিকার মৃৎশিল্পীরা এখন হতাশ। অনেকেই বাপ-দাদার এ পেশা ছেড়ে ঝুঁকছেন বিভিন্ন পেশার দিকে। পোড়া মাটির নানাবিধ কাজ, গৃহস্থালির নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি, পুতুল, খেলনা, প্রতিমা, প্রতিকৃতি, টব, শোপিসসহ অসংখ্য জিনিসের চাহিদা মেটাচ্ছে অল্প কিছু মৃৎশিল্পী। এক সময় কাউকে মাটির তৈরি হাঁড়ি কিংবা গণেশের মূর্তি দিলে বিনিময়ে ওই পাত্রে বা মূর্তির পেটে যত চাল ধরে ততটাই দেওয়া হতো শিল্পীকে। এখন আর সেই রীতি নেই। রাজধানীর রায়েরবাজারের সিটি করপোরেশন মার্কেটের পাশে কথা হয় প্রদীপ কুমার পালের সঙ্গে। সেখানে এককোনে নিজের তৈরি হাঁড়িপাতিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাটির পাত্র নিয়ে দোকান দিয়ে বসেছেন তিনি। তবে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থেকে বানিয়ে এনে এখানে বিক্রি করেন। এ প্রতিবেদককে তিনি জানালেন, আগে অনেকেই মাটির জিনিসপত্র তৈরি করত। কিন্তু দিন খারাপ হওয়ায় এখন হাতেগোনা ৪-৫ জন এই কাজ ধরে রেখেছেন। স্মৃতিচারণ করে বললেন, ছোটকালে দেখতাম বাবা আর দাদায় ঘুরন্ত চাকায় হাত বসিয়ে বিভিন্ন জিনিস বানাতেন। মুন্সিয়ানার সব ছিল হাতেই। তার আগে পাড়িয়ে পাড়িয়ে (পায়ের ছাপ দিয়ে) কাদামাটি নরম আঠাল করা হতো। এরপর তা মাঝখানে রেখে চাক ঘুরিয়েই বানানো হতো হাঁড়িপাতিল। আমাদের উপার্জন নির্ভর করে মূলত দুই হাতেই। পূর্বপুরুষের কারণে একপর্যায়ে আমরাও এ পেশায় জড়িয়ে পড়েছি। কিন্তু এখন আমাদের সেই ব্যবসার দিন আর ভালো যায় না। আগে শহর গ্রামে কয়েকদিন ধরে বৈশাখী মেলা চলত। সেখানে অনেক মাটির জিনিস বেচাবিক্রি হতো। এখন বৈশাখী মেলা হয় খুব কম, হলেও হয় আধা বেলা। তাই বেচাবিক্রি নাই বললেই চলে। তবে পূজা পার্বণে মূর্তি বানিয়ে সংসার চালাতে হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বী মৃৎশিল্পীদের পদবি ‘পাল’। এদের মহল্লাকে বলা হয় পালপাড়া। জানা যায়, আগে ঢাকার প্রাচীন জনপদ রায়েরবাজারের পালপাড়া বেশ নামডাকের ছিল। পালপাড়ায় ছিল দুই শ্রেণির পাল। রাজবংশী পাল ও রুদ্র পালের সমন্বয়ে এখানে গড়ে উঠেছিল মৃৎশিল্পের জমজমাট এক বাজার। যদিও কাগজ-কলমে পালপাড়া বলে কোনো জায়গা এখন আর নেই। এককালে এ এলাকার অসংখ্য মৃৎশিল্পীর হাতে গড়া মৃৎপাত্রের কদর ছিল সারা দেশে। মাটির তৈরি হাঁড়িপাতিল, কলসি, ফুলের টব, সরা, বাসন, দইয়ের মালসা, সাজের হাঁড়ি, মাটির ব্যাংক, শিশুদের বিভিন্ন খেলনা সমগ্রী নানা ধরনের তৈজস তৈরি করত এখানকার কুমারেরা। এসব তৈরির প্রধান উপকরণ এঁটেল মাটি, জ্বালানি কাঠ, শুকনো ঘাষ, খড় ও বালি। রায়েরবাজার সিটি করপোরেশন মার্কেটের পেছনে ছোট্ট এক ঘরে মাটির জিনিস বানান বিপদ পাল। সেখানে গিয়ে জানা গেল আগে তিনি সবধরনের তৈজস বানাতেন। এখন আগুন জ্বালানোর জায়গার অভাবে শুধু পূজায় ব্যবহৃত ছোট ছোট পাত্র নিজ ঘরে বানিয়ে বিক্রি করেন। তারা এও অভিযোগ করেন, অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম, মেলামাইন ও স্টিলের জিনিসপত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজারে টিকতে পারছে না মৃৎশিল্পের আসবাবপত্র। বংশানুক্রমে গড়ে ওঠা গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। ফলে অনেকেই কৃষি, মৎস্য চাষ, রিকশা, ভ্যান নির্মাণ ও চালানোসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়ে তাদের সংসার চালাচ্ছেন। হতাশার মধ্যে আশার কথাও বলছেন তারা। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সাহায্যে তাদের তৈরি সুন্দর সুন্দর জিনিস বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। এসব তৈরিতে তাদের ২০-২২ হাজার টাকা দামের হুইল মেশিনও সরবরাহ করা হয় বলে জানা গেছে। জানা যায়, ১৬০০ সালের দিকে সহজ যোগাযোগব্যবস্থা, উৎকৃষ্ট মাটি প্রাপ্তি এবং দক্ষ মৃৎশিল্পী থাকায় রায়েরবাজারে গড়ে ওঠে পালদের বসতি। এখানকার পশ্চিম পাশ দিয়ে এক সময় বয়ে যেত একটি প্রশস্ত খাল। এই খালের একদিকে বুড়িগঙ্গা এবং অন্যদিকে তুরাগ নদের সঙ্গে যুক্ত ছিল। পালদের তৈরি মৃৎপাত্র নৌকা বোঝাই হয়ে এ খাল দিয়ে দেশের অন্যান্য স্থানে যেত। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক হামলায় রায়েরবাজারের পালদের ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চলে। আগুন দিয়ে তাদের প্রতিটি ঘর জ্বালিয়ে দেয়। এরপর অল্প কিছু বাদে দলে দলে দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যায়।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর