শনিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

‘কতিপয় পুলিশ’

মির্জা মেহেদী তমাল

‘কতিপয় পুলিশ’

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার রেদোয়ান পেট্রল পাম্পের সামনে ফার্নিচার বোঝাই ট্রাকে অভিযান চালিয়ে ৩০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে র‌্যাব। এ ঘটনায় জড়িত থাকায় পুলিশের এসআই বদরুদ্দোজা মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয়। জেরার মুখে বদরুদ্দোজা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত বলে স্বীকার করেন। তার বিরুদ্ধে মিরসরাই থানায় মাদকের মামলা হয়। তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

এ ঘটনার আগে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার এএসআই সোহরাওয়ার্দী রুবেলের কাছ থেকে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে আরও তিন পুলিশ সদস্যের নাম আসে। চারজনের বিরুদ্ধে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করা হয়।

সর্বশেষ গতকাল তিন তরুণকে অপহরণ করে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করায় দুই পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।   তারা হলেন- গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আবদুল্লাহ আল মামুন ও টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার এএসআই মুসরাফিকুর রহমান।

এমন ঘটনা কয়েক দিন পর পরই ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অপরাধে জড়াচ্ছে পুলিশ সদস্যরা। মাদক নির্মূলের দায়িত্ব পালনকারী বাহিনীর সদস্যরা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় মাদকের বিস্তার রোধও হচ্ছে না। এ ছাড়া চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণের ঘটনায়ও জড়িয়ে পড়ছে। এতে পুরো বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। তবে পুলিশ বলছে, পুলিশের কোনো সদস্য অপরাধ করলে তাদের ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। ভবিষ্যতেও দেওয়া হবে না। গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার বলেন, ছাড় দেওয়া হচ্ছে না বলেই দুই পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গাজীপুরে অপহরণের শিকার তিন তরুণ হলেন- কালিয়াকৈর উপজেলার বড়ইবাড়ি এলাকার রায়হান সরকার, লাবিব হোসেন ও শ্রীপুর উপজেলার চন্নাপাড়া এলাকার নওশাদ ইসলাম। অপহরণ করে মুক্তিপণ চাওয়ার অভিযোগে পুলিশের দুই সদস্যের নাম উল্লেখ করে গতকাল কালিয়াকৈর থানায় মামলা করেন রায়হান সরকার। এই মামলায় ৬-৭ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। রায়হান জানান, গত বুধবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ব্যক্তিগত গাড়িতে করে রাজধানীর বাণিজ্য মেলার উদ্দেশে রওনা হন তারা পাঁচ বন্ধু। বিকাল ৫টার দিকে তারা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কালিয়াকৈর উপজেলার সূত্রাপুর এলাকায় শিলা-বৃষ্টি ফিলিং স্টেশনে যান গ্যাস নিতে। গ্যাস নেওয়ার সময় তরিবুল্লাহ ও রাকিবুল রহমান নামে দুই বন্ধু গাড়ি থেকে নেমে পাশের দোকানে চা খেতে যান। বাকিরা গাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। এ সময় দুটি গাড়ি নিয়ে সেখানে হাজির হন এএসআই মামুন ও মুসরাফিকুর। তারা সাদা পোশাকে ছিলেন। মুসরাফিকুরের মাইক্রোবাসে সাদা পোশাকের আরও কয়েকজন লোক ছিলেন। রায়হানের অভিযোগ, তারা রায়হানসহ তিন বন্ধুকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে মাইক্রোবাসে তোলেন। পরে তাদের টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের দেওড়া এলাকায় নির্মাণাধীন উড়ালসড়কের নিচে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিন বন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে ৩০ লাখ টাকা দাবি করেন ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তা। দাবি করা টাকা না দিলে ‘ক্রসফায়ারে’ মেরে ফেলারও হুমকি দেওয়া হয়। পরে বেশ কিছু সময় তাদের সঙ্গে টাকা নিয়ে দেনদরবার হয়। একপর্যায়ে দুই এএসআই ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে জানান। পুলিশ সদর দফতরের একটি সূত্র জানায়, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। তাদের বিষয়ে তদন্ত হয়। দোষী প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সূত্র জানায়, সারা দেশে পুলিশের ৩৮৮ সদস্যের বিরুদ্ধে মাদক সেবন, বিক্রি ও পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে পুলিশ প্রশাসন। তদন্ত শেষে অনেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, অপরাধ দমন করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এসব তথ্য জেনেও অনেক সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কোনো ব্যবস্থা নেন না। শুরুতে কঠোর বার্তা দেওয়া হলে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হলে অন্যরা সতর্ক হতো। তিনি আরও বলেন, পুলিশের কোনো সদস্য অপরাধে জড়িয়ে পড়লে তার পক্ষে রাজনৈতিক অনেক তদবির আসে। এসব তদবিরের কারণে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয় না। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অনেকে অপরাধে জড়ানোর সাহস পায়। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, মাদক নির্মূলের দায়িত্বে থাকা বাহিনীর সদস্যরা মাদক ব্যবসা ও সেবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে সমাজকে মাদকমুক্ত করা অসম্ভব। অন্য ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়ে পড়লেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তাই প্রথমেই শর্ষের ভূত তাড়াতে হবে। জড়িত পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর