রবিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

মাল টেনে বছরের পর বছর

মাহবুব মমতাজী

মাল টেনে বছরের পর বছর

সবসময় তো কাজ জোটে না। সিল্কসিটি, সুবর্ণ আর সোনার বাংলা, এই তিনটা ট্রেনে কিছু ভিআইপি যাত্রী যাওয়া-আসা করেন। তারা কেউ কেউ লাগেজ টানার কাজ দেন। আবার অনেকে নিজেই  নিজের মাল নিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে যান। তথ্যটা দিলেন মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, কোনো দিন হয়তো ২০০ টাকা, কোনো দিন ৫০০ টাকা পাইলাম। আবার কোনো দিন এক টাকাও কামাই হইল না। এভাবেই যাইতেছে বছরের পর বছর। ঢাকা (কমলাপুর) রেলস্টেশনের কুলি মোহাম্মদ আলী। তার নম্বর-৫৪। পঞ্চাশোধ্র্ব আলী ৩০ বছর ধরে কুলির কাজ করছেন এখানে। স্টেশনের ১ নম্বর প্লাটফর্মেই তার আবাসস্থল। পার্সেল ভবনের দক্ষিণে তার সঙ্গে থাকেন আরও অনেকে। দিনে যাত্রীদের লাগেজ টানেন। আর রাতে প্লাটফর্মে ঘুমান। গ্রামের বাড়িতে যান কিনা জানতে চাইলে আলী বলেন, ‘যাই মাঝে মাঝে। বেশির ভাগ সময় টাকা পাঠায় দিই।’  শুধু মোহাম্মদ আলীই নন, কমলাপুর রেলস্টেশনে প্রায় সব কুলির জীবনের কাহিনী এমনই। ময়লা গেরুয়া কাপড়ে, রুগ্ন শরীর নিয়েই তারা বহন করেন হাজারো যাত্রীর মালামাল। কেউ এসেছেন বাড়ি থেকে পালিয়ে, কেউ অভাবের তাড়নায়, আবার কেউ নদীভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে স্টেশনে এসে সঙ্গ পেয়ে বেছে নিয়েছেন কুলির জীবন। স্টেশনের আশপাশের বিভিন্ন বস্তিতে পরিবার নিয়েও থাকেন অনেকে। যুগের পর যুগ এভাবেই কাটছে তাদের দিনরাত। দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় রেল খাতের অনেক উন্নয়ন হলেও তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি এতটুকুও- বলছিলেন কুলি সরদার নুরু মিয়া। রবিবার সরেজমিন ঘুরে জানা যায় এসব চিত্র।

নুরু সরদার ১৯৭৯ সাল থেকে কমলাপুরের কুলি। ১৯৯৭ সালে তিনি কুলি সরদার হয়েছেন। জানালেন, তার বড় ভাই স্টেশনে কাজ করতেন। পড়ালেখা ঠিকমতো করতে না পাড়ায় তাকে এখানে এনে কাজে ধরিয়ে দেন। কুলির কাজ করতে যে ইচ্ছুক তাকে দুই তিন মাস পর্যবেক্ষণ করা হয়, এরপর তালিকায় নাম উঠিয়ে স্টেশন অফিস থেকে অনুমতি নিয়ে নম্বর দেওয়া হয়। নম্বর পেলে কাজ করতে কোনো বাধা নেই। মাল টানা বাবদ কেজিপ্রতি ১৫ টাকা করে নির্ধারণ করা আছে। কেউ খুশি হয়ে বেশি দিতে চাইলে দেবে। দেশের বৃহৎ ও আন্তর্জাতিক রেলস্টেশন ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশন। এখানে প্রতিদিন প্রায় দেড় লাখ যাত্রী আসা-যাওয়া করেন। আর এদের মালামাল বহনে কাজ করেন তালিকাভুক্ত ২২৫ জন কুলি। এরাই শুধু স্টেশনের ট্রলি ব্যবহারের অনুমতি পান, অন্যদের এ সুযোগ নেই। বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) এবং স্টেশন ম্যানেজার কুলি সরদারের মাধ্যমে কুলিদের কাজ করার অনুমতি দিয়ে থাকেন। তারা স্টেশনের লোগো ও নম্বর দেওয়া পোশাক পরে যাত্রীদের ট্রলি বহন করে থাকেন। একসময় কুলিদের কোনো বাধা-ধরা নিয়ম ছিল না। অনেক ধরনের মানুষ কুলির কাজ করতে গিয়ে যাত্রীদের মালামাল চুরি করত। পরে স্টেশন কর্তৃপক্ষ নিয়ম-কানুনের আওতায় নিয়ে আসে।  স্টেশনে কুলিদের মধ্যে যেমন রয়েছেন মাঝবয়সী তেমনি অনেক শিশু-কিশোর এই কঠিন কাজে যুক্ত। তেমনি একজন সোলায়মান (১৫)। জানতে চাইলে সে বলে, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের সঙ্গে চাঁদপুর থেকে ঢাকায় আসি। মা স্টেশনে ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করেন, আর আমি স্টেশনে মাল টানি।’

ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াছিন ফারুক মজুমদার এ প্রতিবেদককে জানান, মালামাল হারানো এবং যাত্রী হয়রানি ঠেকাতে রেলস্টেশনে কুলিদের একটি ডাটাবেজ তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে তাদের ছবিসহ জীবনবৃত্তান্ত রেকর্ড করে রাখা হবে। রেকর্ড রাখা সাপেক্ষে কেউ অপরাধী কিনা তা বাছাই করে এ মাসেই পোশাকসহ একটি নম্বর কুলিদের দেওয়া হবে। ভুক্তভোগীরা সেই নম্বর মনে রাখলে কেউ তাদের মালামাল চুরি করে নিয়ে গেলে দ্রুত তাকে বের করা সম্ভব হবে। স্টেশনের বিশৃঙ্খলা রোধে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কুলিদের বিচরণ শুধু রেলস্টেশনেই নয়, সদরঘাটেও রয়েছে। যাত্রীদের ভোগান্তি ঠেকাতে বছর দুয়েক আগে সেখানে কুলিদের নম্বরসহ আকাশি নীল রঙের পোশাক দেওয়া হয় বিআইডব্লিউটিএ থেকে। শর্ত দেওয়া হয় যে- কেউ যাত্রীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত টাকা আদায় করতে পারবে না। মালামাল বহনে যাত্রী খুশি হয়ে যাই দেবেন তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর