শনিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

তবু গড়াই ধু-ধু বালুচর

নদী বাঁচাও -৭

জহুরুল ইসলাম, কুষ্টিয়া

তবু গড়াই ধু-ধু বালুচর

দেশের উপকূলভাগে মিঠাপানির অন্যতম আধার গড়াই নদী। এমনকি সুন্দরবনে মিঠাপানির চাহিদার বড় অংশ মেটায় গড়াই। তবে দুই দফায় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে খনন কাজ করেও দীর্ঘমেয়াদি কোনো ফল পাওয়া যায়নি। বরং নদীর বর্তমান চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে খনন কাজ হয়েছে। নদীতে পলি পড়ে প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বারবার খননে কাক্সিক্ষত ফল না পাওয়ায় নদীপাড়ের মানুষের মাঝে ক্ষোভ রয়েছে। তাই তৃতীয় দফায় সুন্দরবন রক্ষায় ৫৯০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে কাজ শুরু হবে। ৪ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে ৩৭ কিলোমিটার নদী খনন ও ৭ কিলোমিটার নদীতীর সংরক্ষণ করা হবে।

দেশের উপকূলভাগে মিঠাপানির সরবরাহ নিশ্চিত করা ও সুন্দরবনসহ ওই এলাকার জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গড়াই খনন প্রকল্প নেওয়া হয় ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর। এতে ব্যয় হয় প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এরপর ২০০৯ সালের পর আবার আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ফের দ্বিতীয় দফায় গড়াই খনন প্রকল্পে প্রায় এক হাজার  কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রকল্পটি বছর খানেক আগে শেষ হয়। এরপরও পানি উন্নয়ন বোর্ড দেশীয় অর্থায়নে মেইনটেনেন্স চালিয়ে নদীকে সচল রাখার চেষ্টা করছে। তবে খননে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপরিকল্পিত হওয়ায় এ নিয়ে বিগত সময়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। একাধিক তদন্ত টিমও গঠন করা হয়।

স্থানীয়দের অভিযোগ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, সঠিক গবেষণা, অপরিকল্পিত ড্রেজিং কাজ বাস্তবায়নে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে গড়াই খননে সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। অথচ সুন্দরবনকে রক্ষা ও নোনাপানির আগ্রাসন রুখতে সারা বছর মিঠাপানির প্রবাহ সচল রাখতে প্রকল্পটি নেওয়া হলেও দৃশ্যত তেমন ফল মিলছে না বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা। আগের তুলনায় শুষ্ক মৌসুমে মিঠাপানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গত কয়েক বছরে খুলনা, যশোরসহ কয়েকটি জেলায় নদী অববাহিকায় স্যালাইনিটি (নোনাপানি) বেড়েছে। পরিবেশবিদদের মতে, খুলনা বিভাগের মধ্যে পরিবেশগত দিক থেকে পদ্মার প্রধান শাখা নদী গড়াইকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতেও গড়াই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের  জেলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সুন্দরবনের জন্য গড়াইয়ের মিঠাপানি অপরিহার্য। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হরিপুর ও মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়া এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা থেকে গড়াই উৎস মুখ শুরু হয়েছে। নদীটি কুষ্টিয়া ছাড়াও মাগুরা, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর হয়ে যশোর ও খুলনা হয়ে সুন্দরবনে গিয়ে মিশেছে। সুন্দরবন ছাড়াও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে নোনাপানির আগ্রাসন রুখতে বড় ভূমিকা রাখে গড়াইয়ের মিঠাপানি। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, বর্ষা মৌসুমে গড়াই নদীর দুই কূল পানিতে উপচে পড়লেও শুষ্ক মৌসুমে নদীর চেহারা একেবারেই ভিন্ন। খনন কাজ চলার পরও শুষ্ক মৌসুম এলে দেখা যায় পানি শুকিয়ে প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে নদীর অবস্থা একেবারেই করুণ। নদীর বড় বাজার ঘোড়া ঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে নদীর পানি শুকিয়ে গেছে। স্রোত ও প্রবাহ নেই। এখানে মানুষ হেঁটেই নদী পার হচ্ছে। সাইকেল চালিয়েও নদী পার হচ্ছে অনেকে। খাদে সামান্য পানি জমে আছে। সেখানে গোসলসহ কাপড় ধোয়ার কাজ করছে স্থানীয়রা। স্থানীয় বাসিন্দা নাজমুল হোসেন বলেন, ‘খননের পরও নদীতে পানি নেই। জায়গায় জায়গায় কিছু পানি জমে আছে। বালু পড়ে শুকিয়ে গেছে।’ স্থানীয় রাশেদা খাতুন বলেন, ‘পানির খুব সমস্যা। নদী পাড়ে যারা বসবাস করে তারা বেশি সমস্যায় ভুগছে। চাপকলে পানি ওঠে না। আবার নদীতেও পানি নেই। যা আছে তাতে গন্ধ।’ গত দেড় যুগ আগেই পলি ও বিপুল বালু জমে গড়াই নদীতে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। নদীকে আগের রূপে ফিরিয়ে আনতে ১৯৯৭ সালে সর্ব প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গড়াই নদীর মুখে মাটি কেটে পরীক্ষামূলক নদী খননের কাজ উদ্বোধন করেছিলেন। পরের বছর ১৯৯৮ সালে এ নদী পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়।  নেদারল্যান্ডসের কোম্পানি জিআরসির মাধ্যমে জোরেশোরে এ কাজটি শুরু হয়। জিআরসির কাজ শেষ হওয়ার কয়েক বছর না যেতেই ফের মরুকরণের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর গড়াই নদীর পাানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখা, এলাকার খাদ্য নিরাপত্তা রক্ষা করা, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা, সুন্দরবন এলাকার লবণাক্ত দূরীকরণ, দক্ষিণাঞ্চলের মিষ্টি পানিপ্রবাহ বৃদ্ধিসহ আরও বেশ কয়েকটি লক্ষ্য নিয়ে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ৪ বছর মেয়াদি বৃহত্তর আকারের ড্রেজিং করতে ‘গড়াই নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্প-২’ প্রকল্প গ্রহণ করে। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯৪২ কোটি টাকা।

এদিকে নতুন করে ফের তৃতীয় ধাপের খনন কাজ করতে একটি মেগা প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। একনেকে পাস হয়েছে ৫৯০ কোটি টাকা। টেন্ডারের প্রক্রিয়া শেষে এ বছরই নতুন করে বড় পরিসরে খনন কাজ শুরু হবে। ভাঙনকবলিত কয়েকটি স্থানে ৭ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া ৩৭ কিলোমিটার নদী খনন করা হবে। কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পীযুষ কৃষ্ণ কু ু বলেন, ৫৯০ কোটি টাকার কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হলে এ বছরই শুরু হবে। এবার প্রকল্পে স্বচ্ছতার বিষয়ে জোর দেওয়া হবে। কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক মো. আসলাম হোসেন বলেন, গড়াই কুষ্টিয়াসহ আশপাশের জেলার লাইফ লাইন। এটি সচল রাখতে সরকার ৫৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। অচিরেই খনন কাজ শুরু হবে। পরিবেশ ও নদী গবেষক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রেজওয়ানুল ইসলাম বলেন, ‘সঠিক পরিকল্পনা না থাকায় গড়াই খননে শত শত কোটি টাকা খরচ করেও তেমন সুফল মিলছে না। বালু খনন করে যদি নদী পাড়েই রাখা হয় তাহলে সমস্যা দূর হবে না। বালু সরিয়ে নিতে হবে। গড়াই আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদী। গড়াই না বাঁচলে এ অঞ্চল থেকে অনেক মাছ ও জলজ প্রাণী হারিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে অনেক পাখি ও মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে সুন্দরবন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর