রবিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
তৃণমূলে স্বাস্থ্যসেবা

জনবল সংকট অনিয়ম লুটপাটে লালমনিরহাট সদর হাসপাতাল

রেজাউল করিম মানিক, লালমনিরহাট

লালমনিরহাট জেলার ১৪ লাখ মানুষের জন্য একমাত্র ১০০ শয্যার হাসপাতালটি কার্যত চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। একদিকে জনবল সংকট। অন্যদিকে অনিয়ম আর দুর্নীতি। চিকিৎসক সংকটের কারণে হাসপাতালটি চলছে উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার, প্যারামেডিকস ও ডেন্টাল টেকনিশিয়ান দিয়ে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দুর্নীতি আর লুটপাট।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোগীদের জন্য সরকারিভাবে এই হাসপাতালে প্রতি বছর প্রায় কোটি টাকার ওষুধ সরবরাহ করা হয়। রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রতি বছর লাখ লাখ টাকার আধুনিক ভারী যন্ত্রপাতি কেনা হয়। কিন্তু রোগীদের রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয় বাইরে থেকে। ‘ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন নেই’ অজুহাতে হাসপাতালে আগত রোগীদের ডিজিটাল এক্স-রে করাতে বাইরে ব্যক্তি মালিকানাধীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো হয়। রোগীরা অভিযোগ করেছেন, এক্স-রে এবং প্যাথলজি বিভাগের টেকনিশিয়ান ও বহির্বিভাগের ডাক্তাররা হাসপাতালের আশপাশের কয়েকটি ডিজিটাল এক্স-রে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। টেকনিশিয়ানদের ব্যবসায়িক ক্ষতির আশঙ্কায় এ হাসপাতালে ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন কেনা হয় না। রোগী, তাদের স্বজন এবং চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম-দুর্নীতি আর দলবাজি গ্রাস করেছে জেলার চিকিৎসার একমাত্র ভরসা এ হাসপাতালটি। রোগীদের সপ্তাহের দুই দিন মাংস, দুই দিন ডিম ও দুই দিন মাছ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও পুরো সপ্তাহজুড়েই দেওয়া হচ্ছে নিম্নমানের বিভিন্ন মাছ। হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট দীর্ঘদিন থেকে দায়িত্ব পালন করলেও হিসাব হালনাগাদ করেননি। অধিকাংশ ওষুধই কালো বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দু-একটি ছাড়া রোগ পরীক্ষার এমন কোনো যন্ত্র নেই যা এই হাসপাতালে নেই। কিন্তু নানা ছলচাতুরীতে বছরের বেশির ভাগ সময় সেগুলো অকেজো করে রাখার অভিযোগ রয়েছে। কোটি টাকার ভারী যন্ত্রপাতি থাকলেও সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নেই কোনো প্রকৌশল বিভাগ। ইচ্ছাকৃত হোক আর অনিচ্ছাকৃত হোক একটি যন্ত্র বিকল হলে ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ এসে সেটি মেরামত করতে মাসও কেটে যায়। এই ফাঁকে লাভবান হন রোগ পরীক্ষার ব্যবসায়ীরা। এই কাজের হোতা হাসপাতালের এমটি ল্যাব। জাহেদুল ইসলাম এই হাসপাতালে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে কর্মরত। তিনি শহরে প্রতিষ্ঠা করেছেন ইসলাম প্যাথলজি নামের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার। হাসপাতালে যেসব রোগী যান তাদের কৌশলে তার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে দেন। আর হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। আরও জানা যায়, দলীয় প্রভাবের কারণে হাসপাতালে কর্মরত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির অনেক কর্মচারী দিনের শুরুতে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। কেউ কেউ ব্যস্ত থাকেন ব্যবসা, রোগীর দালালিসহ আয়বর্ধক ধান্দা নিয়ে। প্রতিটি শিফটে ৫-৬ জন করে নার্স প্রতিটি ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও বাস্তবে ২-৩ জনের বেশি থাকেন না। হাসপাতালে বিত্তবান রোগীদের জন্য ভাড়ার বিনিময়ে বিশেষ শয্যার (পেয়িং বেড) ব্যবস্থা রয়েছে। এ ভাড়ার টাকার সঙ্গেই রয়েছে তাদের তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা। কিন্তু পেয়িং কেবিন ও পেয়িং বেডে থাকা রোগীরা কখনোই হাসপাতালের খাবার পান না। তাদের জন্য বরাদ্দকৃত খাবার সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রায়ই অক্সিজেন সিলিন্ডার সংকট দেখা দেয়। গত বছর যথাসময়ে অক্সিজেন না পাওয়ায় শিশুমৃত্যুর ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল। হাসপাতালে যে সংখ্যক অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকার কথা, বাস্তবে তা নেই। কারণ সরকারি হাসপাতালের অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়েই চলছে ব্যক্তি মালিকানাধীন অ্যাম্বুলেন্স এবং ক্লিনিক। সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মচারীদের মাসোয়ারা দিয়ে সরকারি অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালের অর্ধশত অক্সিজেন সিলিন্ডারের হদিস নেই বলেও জানিয়েছে নির্ভরযোগ্য সূত্র। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালে দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে হয়রানির ঘটনা নিয়মিত। কতিপয় অসাধু চিকিৎসকের বিরুদ্ধে রোগীদের ভালো চিকিৎসার প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন ক্লিনিকে প্রেরণের বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। অপ্রয়োজনে বিভিন্ন ডায়াগনসিস আইটেমের তালিকা রোগীর হাতে ধরিয়ে চিকিৎসকের পছন্দের ক্লিনিকে যেতে বাধ্য করানোর ঘটনা ঘটছে। অন্যথায় রিপোর্ট ছুড়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এ ছাড়া শল্যচিকিৎসার রোগীদের ক্ষেত্রে ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি। হাসপাতালটি ১০০ শয্যার হিসেবে চালু থাকলেও দীর্ঘদিন থেকে ৫০ শয্যার মঞ্জুরি করা চিকিৎসকের পদ দিয়ে পরিচালিত হয়ে আসছে। মঞ্জুরি করা চিকিৎসকের ৩৯টি পদের মধ্যে ২৩টি পদই বর্তমানে শূন্য। রোগীরা জানান, লালমনিরহাটে সুচিকিৎসা থাকলে রংপুরে যেতে হতো না। জানা যায়, চিকিৎসক স্বল্পতার কারণে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে মোগলহাট ইউনিয়নের প্যারামেডিকস আবির বিন আক্তার, হাসপাতালের ডেন্টাল টেকনিশিয়ান কবির হোসেন ও লালমনিরহাট পৌর এলাকার সাপটানা বাজার উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজাউল করিমকে দিয়ে জরুরি বিভাগ ও আউটডোরে চিকিৎসার কাজ করানো হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক জানান, বর্তমান সরকারের আমলে জেলা সদরের এ হাসপাতালটিতে নজিরবিহীন বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক সংকট চলছে। তিনি আরও জানান, সারা জেলার বাকি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অবস্থাও প্রায় একই। এ ব্যাপারে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. গোলাম মোহাম্মদ জানান, প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ অন্যান্য চিকিৎসক না থাকায় রোগীদের ভালো চিকিৎসার জন্য নিজস্ব ভাড়ায় হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়ে থাকে। লালমনিরহাট জেলার সিভিল সার্জন ডা. আবুল কাসেম চিকিৎসক সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, রংপুর থেকে লালমনিরহাটের চিকিৎসকদের এ হাসপাতালে বদলি করে সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। কারণ অন্য এলাকার চিকিৎসকরা এখানে এসে থাকতে চান না।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর