সোমবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
ভিন্ন পেশা

সাবান-ব্রাশ ঘষতে ঘষতে হাতের চামড়া উইঠ্যা যায়

মাহবুব মমতাজী

সাবান-ব্রাশ ঘষতে ঘষতে হাতের চামড়া উইঠ্যা যায়

বৃষ্টি। আকাশের মুখ অন্ধকার। এমন দিনে জরুরি প্রয়োজন না হলে কেউ কাপড় ধোয়ার কথা চিন্তাও করেন না। অথচ ব্যতিক্রম সরকারি হাসপাতাল ও দক্ষিণখান তুরাগ নদীর পাড়। দক্ষিণখানের কোটবাড়ী এলাকার রেলব্রিজের নিচে চলে কাপড় ধোলাইয়ের মহাযজ্ঞ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, তীব্র দাবদাহ কোনো কিছুতেই এ কাজ থামাতে পারে না।

প্রতিদিন তুরাগ নদের পাড়ে দুই থেকে পাঁচ হাজার পিস কাপড় ধোলাই হয়। এখানে প্রায় ৪০ বছর ধরে কাজ করেন বিল্লাল হোসেন। সহযোগিতার জন্য আছেন আরও ১৫ জন। কোটবাড়ীর রেলব্রিজের পূর্বপাশে তুরাগ নদের রেলব্রিজের পিলারের শানে বসে কেউ কাপড় ধুচ্ছেন,  কেউ তা রেললাইনের দুই ধারে নেড়ে দিচ্ছেন। আর ৫৫ বছর বয়সী বিল্লাল কাজে হাত লাগানোর পাশাপাশি পুরো কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। বিল্লালের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। তুরাগ পাড়ে কাপড় ধোলাইয়ের কাজ করে পার করেছেন যৌবনকাল। বর্তমানে তিনি এ কাজের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। বিল্লালের বাবা ও বড় ভাইও এ কাজ করেছেন আগে। কৈশোর পার হওয়া কয়েকজন তরুণকেও দেখা গেল এ কাজ করতে। প্রতিদিন নোংরা কাপড় ধুতে খারাপ লাগে কি-না জানতে চাইলে বিল্লাল বলেন, অভ্যাস হয়ে গেছে। তবে যে পরিমাণে কষ্ট, আয় নেই সে অনুপাতে। এখন আর লন্ড্রি কিংবা বাসা-বাড়ির কাপড় ধোলাই করা হয় না। পাইকারি কাপড় ব্যবসায়ীদের কাপড় এনে ধোলাই করা হয়। পরে শুকিয়ে ইস্ত্রি করে আবদুল্লাহপুর, আজমপুর, জসীমউদ্দীন, পল্টন, গুলিস্তান ও মতিঝিলের বিভিন্ন ফুটপাথে বিক্রি করা হয়।  পাশ থেকে তরুণ বয়সী এক শ্রমিক সকাল থেকে পানিতে ভিজতে থাকা সাদাটে হয়ে যাওয়া হাত দেখিয়ে বললেন, বল সাবান আর হাত ব্রাশ দিয়ে কাপড় ধোলাই করতে হয়, ফলে হাত ভিজতে ভিজতে চামড়া উইঠ্যা যায়। জ্বলে। দিনে গড়ে ১০০ কাপড় ধুইতে পারি। নদীর পানি খারাপ হওয়ায় রাতের বেলা ঘুমাইতে গেলে হাত-পা চুলকায় আর জ্বলে। তবে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করার মতো সময় নেই তাদের। তাই তারা যে যার কাজে মন দিলেন। সরেজমিন দেখা যায়, এখানে দূষিত ময়লা-আবর্জনায় ভাসা তুরাগ নদের বিষাক্ত পানিতে ধোলাই করে রং মেখে, নদীর পাড়ে শুকিয়ে ঝকঝকে নতুন করে তোলা হচ্ছে পুরনো কাপড়। তারপর প্যাকেট করে বিক্রি করা হচ্ছে শিল্পনগরী টঙ্গীর বিভিন্ন ফুটপাথসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে। প্রতিদিন শার্ট, প্যান্ট, শাড়ি, লুঙ্গি, হাসপাতাল-ক্লিনিকের বেডশিট ও পর্দাসহ বিভিন্ন ধরনের কাপড় ধোলাই করা হয়। মিজানুর রহমান নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, এখন যারা ধোপা এরা কাপড় বিক্রেতাদের কাপড় ধোলাই করে শুকিয়ে দেন। বিনিময়ে ৫-৬ টাকা করে পান কাপড় প্রতি। তবে এই এলাকার বউবাজারে পেশাদার ধোপা পাওয়া যেত। তারা বাসা-বাড়ির কিংবা লন্ড্রির কাপড় ধুয়ে দিত। এখন প্রায় মানুষের ওয়াশিং মেশিন হয়েছে, লন্ড্রির দোকানদার নিজেরাই ধোলাইয়ের কাজ করছে। তাই তারা কাজ হারিয়ে পেশা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে।

জানা গেল, শুধু দক্ষিণখানেই নয়, টঙ্গীতেও তুরাগের বিষাক্ত, বিবর্ণ, দুর্গন্ধময় ও কালচে পানিতে বিভিন্ন কাপড় ধোয়া ও রং করা পেশায় জড়িত শ্রমিকরা হাতে-পায়ে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তুরাগ পাড়ের পুরনো কাপড় ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন বলেন, টঙ্গী রেলব্রিজের কাছে পুরনো কাপড় ধোয়ার লোকদের পাওয়া যায়। সেজন্য আশুলিয়া থেকে গাড়িতে করে ম্যানেজার দিয়ে কাপড় পাঠিয়ে দিই। ওরাই ধুয়ে রং করে শুকিয়ে গাড়িতে দিয়ে দেয়। ঢামেকে দেখা যায়- পানির বড় একটি চৌবাচ্চার মধ্যে কেমিক্যাল মেশানো ঘোলা পানি। প্রায় কোমর ছুঁই-ছুঁই পানিতে দাঁড়িয়ে কাপড় ধোলাইয়ে ব্যস্ত ধোপারা। প্রথমে কাপড় বাছাই করা হয়। তারপর সেদ্ধ করা হয়। তারপর কেমিক্যাল মেশানো পানিতে ভিজিয়ে ঘষে ঘষে কাপড়ে লেগে থাকা রক্ত ও অন্যান্য দাগ তোলা হয়। প্রতিদিন সকাল ৭টা  থেকে দুপুরে কিছুটা বিরতি দিয়ে কাজ চলে প্রায় বেলা ৩টা পর্যন্ত।

সর্বশেষ খবর