মঙ্গলবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
নদী বাঁচাও ১০

কীর্তনখোলা-আড়িয়ালখাঁর যৌবন এখন গল্পে

রাহাত খান, বরিশাল

কীর্তনখোলা-আড়িয়ালখাঁর যৌবন এখন গল্পে

এক সময়ের বহমান কীর্তনখোলা এখন নি®প্রাণ খাল -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ভারতের আসাম থেকে কলকাতা রুটের স্টিমার চলাচল করত বরিশালের আড়িয়ালখাঁ আর কীর্তনখোলা হয়ে। এ ছাড়া বরিশাল-ঢাকা ও বরিশাল-চট্টগ্রাম রুটের স্টিমার, জাহাজ, গয়নাসহ পণ্য ও যাত্রীবাহী বড় বড় নৌযান চলাচল করত এই দুটি নদ-নদী হয়ে। এই নৌযানগুলো নোঙর করত বরিশাল শহরতলির তালতলী বন্দরে। নৌবন্দরকে কেন্দ্র করে সরগরম ছিল তালতলী। কিন্তু সেসব এখন শুধুই স্মৃতি। মাত্র পাঁচ দশকে হারিয়ে গেছে প্রবহমান দুটি নদ-নদী। নদ-নদীর সঙ্গে হারিয়ে গেছে ওই এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের জৌলুসও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময় মতো পরিচর্যা করা হলে এ অবস্থা হতো না আড়িয়ালখাঁ আর কীর্তনখোলার। বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া থেকে তালতলী, নোমরহাট হয়ে কীর্তনখোলা নদী আড়িয়ালখাঁ নদে মিশেছে গাজীর খেয়াঘাট এলাকায়। সেখান থেকে রৌপদী-মীরগঞ্জ, মুলাদী, হিজলা হয়ে আড়িয়ালখাঁ শেষ হয়েছে মেঘনা নদীতে। এই আড়িয়ালখাঁ আর কীর্তনখোলাই ছিল কলকাতা-আসাম, বরিশাল-ঢাকা, বরিশাল-চট্টগ্রাম রুটের নৌযান চলাচলের প্রধান মাধ্যম। কিন্তু সেসব এখন শুধুই ইতিহাস- বলছেন বাবুগঞ্জের নোমরহাট কোলচর এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা সৈয়দ আজগর মীরা। তিনি বলেন, আড়িয়ালখাঁ আর কীর্তনখোলা ছিল চার-পাঁচ কিলোমিটার প্রশস্ত এবং প্রায় ১৪০ হাত (২১০ ফিট) গভীর। সুতা ধরলে ¯্রােতের তোড়ে ছিঁড়ে যেত। নৌকা চালিয়ে এপার থেকে ওপার যাওয়ার সাহস ছিল না। এই রুট দিয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটের যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযান চলত। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর আগে আড়িয়ালখাঁ নদের শায়েস্তাবাদের আইচা-৯৬ মৌজা পয়েন্টে চটের বস্তাবোঝাই সাতটি ফ্লাট এবং তালতলীর সামনে কীর্তনখোলার আদাবাড়িয়া পয়েন্টে তিনটি ফ্লাট ডুবে যায়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে পাক হানাদার ও তাদের দোসররা নৌপথে পালিয়ে যাওয়ার পথে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় কীর্তনখোলার ঝুনাহার পয়েন্টে ডুবে যায় আরও দুটি স্টিমার। মূলত এর পর থেকেই কামারপাড়া মৌজা পয়েন্ট থেকে শুরু হয় নদীতে চর পড়া। নোমরহাট কোলচর এলাকার বাসিন্দা সৌদি প্রবাসী সৈয়দ লিটন বলেন, তিনি তার ছোটবেলায়ও আড়িয়ালখাঁ আর কীর্তনখোলার ভরা যৌবন দেখেছেন। তখন এই রুট দিয়ে বড় বড় নৌযান চলত। চার-পাঁচ কিলোমিটার প্রশস্ত নদী এভাবে চর পড়ে নিশ্চিহ্ন হযে যাবে, তা কোনো দিন কেউ ভাবেনি। লিটন বলেন, গল্পের মতো মনে হলেও এটিই বাস্তবতা যে, প্রমত্ত আড়িয়ালখাঁ ও কীর্তনখোলা এখন ‘মরা খাল’। তালতলী এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা আবদুল মতলেব হাওলাদার বলেন, আড়িয়ালখাঁ ও কীর্তনখোলার মূল চ্যানেল যখন নাব্যতা হারাতে শুরু করে, তখন থেকেই কীর্তনখোলা প্রবহমান হতে শুরু করে চরমোনাই পয়েন্ট দিয়ে। নাব্যতা হারাতে হারাতে প্রবহমান নদী যে এভাবে মরে যেতে পারে, তা আড়িয়ালখাঁ আর কীর্তনখোলার নোমরহাট পয়েন্ট না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না- বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন প্রবীণ মতলেব হাওলাদার। ওই এলাকার আরেক প্রবীণ মো. সুলতান ফরাজী বলেন, এই মরা নদী দিয়ে এক সময় আসাম-কলকাতা রুটের স্টিমার চলত। তালতলী বাজারে একটি জেটি ছিল। ওই জেটিতে লঞ্চ-স্টিমার-জাহাজসহ বড় গয়না ভিড়ত। জেলার হিজলা, মুলাদী, খাসেরহাট, গৌরনদী, টরকী থেকে বড় বড় গয়নায় শত শত মানুষ বরিশাল আদালতে হাজিরা দিতে আসতেন। প্রতিদিন হাজারো কলস দুধ আসত বিভিন্ন এলাকা থেকে। হাজারো মানুষের আনাগোনোর কারণে তালতলী ছিল জমজমাট। কিন্তু সেসব এখন শুধুই স্মৃতি। নদীর নাব্যতা হারানোর পাশাপাশি তালতলী বন্দরের ব্যবসা-বাণিজ্যও হারিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে নদীকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষের হাহাকারও বেড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা মো. লিটন বলেন, চর পড়ে যাওয়া নদীর দুই তীরে কৃষি ছাড়াও গড়ে উঠেছে হাজারো বসতি। যারা আগেভাগে খাজনা দিয়েছে, চর পড়ে যাওয়ার পর তারা তাদের জমি দখলে নিয়েছে। আর যারা খাজনা দেয়নি তাদের জমি খাস খতিয়ানভুক্ত হয়ে গেছে। নদীগবেষক বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল স্ট্যাডিজ অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রভাষক মো. আলমগীর হোসেন বলেন, প্রাকৃতিক কারণে আজকের প্রবহমান নদী কয়েক দশক পর তার গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে। তবে নাব্যতা সংকটের শুরুর দিকে যদি নদীগুলোর পরিচর্যা করা হতো, সঠিক সময়ে সঠিক পয়েন্টে ড্রেজিং করা হতো, তাহলে প্রবহমান নদীর আজ এই করুণ পরিণতি হতো না। সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবেই প্রবহমান নদী আজ মরে গেছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শতাব্দীব্যাপী ব-দ্বীপ গবেষণা প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এই প্রজন্ম না হলেও পরবর্তী প্রজন্ম সুফল পাবে। পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে নদীর নাব্যতা সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর